কক্সবাজারসহ সারা দেশে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম। এতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা কক্সবাজারে কৌশলে ভোটার হতে তৎপরতা শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। এ লক্ষ্যে ভোটার হওয়ার জন্য তারা নানা পন্থা অবলম্বন করছে। কেউ ধরছে দালাল, কেউ আবার পরিচয় গোপন করে ভোটার হতে চেষ্টা করছে।
এতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছে পুরাতন রোহিঙ্গারা। তারাই মূলত নতুন রোহিঙ্গাদের কৌশলে নাম পরিচয় গোপন করে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে ভোটার হতে সহায়তা করছে। এছাড়া পুরাতন ভোটার হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ছেলেমেয়েরা অবাধে ভোটার তালিকায় নাম উঠানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই দ্রুত সকল পুরাতন রোহিঙ্গাদের তালিকা করে তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র বাতিল করে হালনাগাদ ভোটার কার্যক্রমে কোন ভাবেই যেন রোহিঙ্গা ভোটার হতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর হওয়ার দাবী জানান সচেতন মহল।
এদিকে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে কাজ করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বেশ কিছু সংগঠন। সেই সঙ্গে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিশনও (ইসি)।
গত ২০ মে থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ। ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ২৬টি বিধিনিষেধ মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে ইসি।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা মাদক, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারা দালালের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজ তৈরি করে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অনেক রোহিঙ্গা তরুণ-যুবক বাংলাদেশি পরিবার থেকে মা-বাবা ভাড়া করে আনছে। আত্মীয় ভাড়া করে আনছে। বাংলাদেশিরা এসে সন্তান পরিচয় দিয়ে ভোটার করার জন্য চাপ দিচ্ছে। আর এদের পেছনে আছেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বাররা।
তারই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (৩১ মে) দুপুরে কক্সবাজার সদর নির্বাচন অফিসে ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য ছবি তুলতে গিয়ে আবদুল মানিক নামক একজন রোহিঙ্গার আবেদন ফরম (নং- ১১০১৫৫০৮৬, ভোটার এলাকা- ১০৮৭) জব্দ করেছেন সদর নির্বাচন অফিসার শিমুল শর্মা। যদিওবা সে নূর হোসেন নামে ফরমটি পূরণ করেছে।
নির্বাচন অফিসার শিমুল শর্মা জানান, অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে ফরমটি জব্দ করা হয়েছে। বিস্তারিত তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে, জনপ্রতিনিধিসহ প্রয়োজনীয় সবার স্বাক্ষর ও এতোগুলো কাগজপত্র কিভাবে জোগাড় করল, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এ কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত মানিক কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ভিলেজার পাড়ার বাসিন্দা মরহুম শামসুল আলমের ছেলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহাব উদ্দিন বলেন, স্মার্ট কার্ড বা আইডি কার্ডসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করি না। রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে সহায়তা করার প্রশ্নই আসে না। কেউ জালিয়াতি করে থাকলে শাস্তি হওয়া দরকার।
ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে কেউ সহায়তা করলে অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার।
রোহিঙ্গারা মাদক, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারা দালালের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজ তৈরি করে ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক নুনিয়ারছড়া সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সম্প্রতি হালনাগাদ ভোটার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ভোটার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এখনো পৌর এলাকা বা সদরে শুরু হয়নি। কিন্তু আমাদের জানা মতে, এখন থেকেই অনেক পুরাতন রোহিঙ্গারা কৌশলে তাদের অনেক আত্মীয় স্বজনকে ভোটার করার জন্য কক্সবাজার পৌরসভাসহ জেলা বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে কৌশলে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদপত্র, বিশেষ প্রত্যায়নপত্র সংগ্রহ করছে। রোহিঙ্গাদের হাতে থাকা অনেক জাতীয় পরিচয়পত্র ভুয়া। তারা ঢাকা চট্টগ্রাম, ফেনী কুমিল্লাসহ অনেক জায়গার ঠিকানা দিয়ে ভোটার হয়েছে। বাস্তবে অনেকে এনআইডি কেন্দ্রীয় সার্ভারেও নেই। কিন্তু সেগুলো যাচাই বাছাই করার কোন সুযোগ নেই। সে কারণে তারা নতুন রোহিঙ্গাদের ভাই, বোন, ছেলেমেয়ে পরিচয় দিয়ে ভোটার করাচ্ছে।
সদরের খুরুশকুল এলাকার এক ইউপি সদস্য বলেন, খুরুশকুল পেচাঁরঘোনা এলাকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে আলী হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা বর্তমানে জেল গেইট এলাকায় বহুতল ভবনের মালিক। তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেওয়ার পরে তদন্তাধীন আছে। কিন্তু সেই আলী হোসেন বর্তমানে তার পরিচয় পত্র দিয়ে অনেক নতুন রোহিঙ্গা এবং তার ছেলেমেয়েকে ভোটার করানোর জন্য কাজ করছে। একইভাবে খুরুশকুল টাইমবাজার এলাকার পাশে আবদুল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা সম্প্রতি বিশাল বাড়ি করেছে। সেখানে সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করেছে। তার বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ও তার নামে থাকা এনআইডি দিয়ে নতুন রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জন্য কাজ করছে।
কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে ২৬টি বিধিনিষেধ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভোটার হতে সহযোগিতা করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা হবে। ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে ইসির সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্তক থাকার নিদের্শ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কারো গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করে মূলত ১৯৭০ সালের পর থেকে। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে রোহিঙ্গাদের বড় একটি গ্রুপ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। কিন্তু ২০১৭ সালে সামরিক জান্তা রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৮
আপনার মতামত জানানঃ