যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ।
মানবাধিকার নিয়ে বুলি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রেই দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে বন্দুক হামলা। করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সুনামির মতো বেড়েছে বন্দুক হামলা। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি শপিংমলগুলোতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এ নির্মম ঘটনা। প্রতিনিয়তই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন মার্কিনিরা। দেশটিতে এটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও মহামারিতে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে ১৯ শিক্ষার্থীসহ ২১ জন নিহত হয়েছে। স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার(২৪ মে) গুলির এ ঘটনা ঘটে। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, অঙ্গরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর পাবলিক সেফটি এ তথ্য জানিয়েছে।
টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ধারণা করা হচ্ছে, ১৮ বছর বয়সী এক কিশোর প্রথমে তার দাদিকে গুলি করে রব এলিমেন্টারি স্কুলের দিকে যায় এবং একটি হ্যান্ডগান নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় সম্ভবত একটি বন্দুকও তার সঙ্গে ছিল।
গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট জানান, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে টেক্সাসেস রব এলিমেন্টারি স্কুলে এ ঘটনা ঘটে। স্কুলটি আমেরিকার সপ্তম বৃহত্তম শহর সান আন্তোনিও থেকে প্রায় ৮৩ মাইল (১৩৩ কি.মি.) পশ্চিমে অবস্থিত। এটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর শিক্ষার্থীদের বয়স পাঁচ থেকে ১১ বছর।
অ্যাবট আরও জানিয়েছেন, বন্দুকধারী ওই ব্যক্তির নাম সালভাদর রামোস। তার বয়স ১৮। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। তিনি শুটিংয়ের সময় একটি হ্যান্ডগান এবং সম্ভবত একটি রাইফেল ব্যবহার করেছিলেন। যদিও এটি এখনও নিশ্চিত নয়।
সংবাদ সম্মেলনে গ্রেগ অ্যাবট বলেন, ওই সময় দুই পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। তবে তাদের অবস্থা গুরুতর নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই বন্দুকধারী একাই হামলা চালিয়েছেন। তবে কেন হামলা চালিয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি।
টেক্সাসের সিনেটর রোল্যান্ড গুতেরেস সিএনএনকে জানিয়েছেন, হামলায় তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও মারা গেছে। তবে এই তিনজনের মধ্যে হামলাকারীও রয়েছেন কি না তা নিশ্চিত নয়।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পুলিশ ছোট ছোট শিশুদের স্কুল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব শিশুর বয়স সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে বলে ধারণা করা যায়।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পুলিশ ছোট ছোট শিশুদের স্কুল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব শিশুর বয়স সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে বলে ধারণা করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১২ সালের পর থেকে এটিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা। ওই বছর কানেক্টিকাটের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকহামলায় ২০ শিশু ও ছয় কর্মকর্তা নিহত হন।
এদিকে, রব এলিমেন্টারি স্কুলে প্রাণঘাতী এ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৮ মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, যে জন্য বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন আরও কঠোর করার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, জাতি হিসেবে আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আমরা কখন বন্দুক লবির বিরুদ্ধে দাঁড়াবো? যা দরকার তা আমরা কবে করবো? আমরা কেন এমন হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাঁচতে চাই?
তিনি বলেন, আমি পীড়িত ও ক্লান্ত। আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। বলবেন না যে, এমন হত্যাকাণ্ডের ওপর আমরা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবো না।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বন্দুক হামলা ও তাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সেখানে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো কঠোর করা যায়নি। মার্কিন কংগ্রেসে এ বিষয়ে কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সেগুলো।
গত ১৪ মে নিউইয়র্কে একটি মুদি দোকানে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে ১৮ বছরের এক কিশোর। নিজেকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান অধ্যুষিত এলাকাটিতে হামলা চালায় সে।
এর একদিন পরেই ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি চার্চের দরজায় দাঁড়িয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় এক বন্দুকধারী। এতে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২০ সালে দেশটিতে ১৯ হাজার ৩৫০টি বন্দুকহামলার ঘটনা ঘটেছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও হেইট ক্রাইমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে।
আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ