যুক্তরাষ্ট্রের শাটডাউন নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি শুধু আমেরিকার রাজনীতি নয়, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফেডারেল সরকারের অচলাবস্থা, বিপুল সংখ্যক কর্মীকে ছুটিতে পাঠানো, চাকরি হারানোর শঙ্কা এবং এর পেছনে রাজনৈতিক দোষারোপ––সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন এক অনিশ্চয়তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। শাটডাউন শুরু হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই সাত লাখেরও বেশি ফেডারেল কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হতে পারে বলে সতর্ক করেছে হোয়াইট হাউজ। কংগ্রেস নতুন বাজেট নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত কার্যক্রম ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, এমনকি অনেক জরুরি সেবাও বিঘ্নিত হওয়ার পথে।
প্রতি বছর মার্কিন কংগ্রেসে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জন্য বাজেট অনুমোদন করতে হয়। ১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অর্থবছর শুরু হয়, তার আগে বাজেট পাশ না হলে সরকার শাটডাউনে চলে যায়। ইতিহাসে এর আগে একাধিকবার এমন পরিস্থিতি হয়েছে, তবে এবার বিষয়টি আরও বড় আকার ধারণ করছে। কারণ রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় হয়ে আছেন। রিপাবলিকানরা চাইছে একটি স্বল্পমেয়াদী স্টপ গ্যাপ ব্যবস্থা, যা মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এবং বর্তমান হারে তহবিল চালু রাখবে। কিন্তু ডেমোক্রেটরা বলছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে অর্থায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া তারা কোনো ব্যয় পরিকল্পনা মানতে পারবে না।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, মাঝে মাঝে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা কারও পছন্দ নয়, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে নিতে হয়। তিনি দাবি করেছেন, ডেমোক্রেটদের অযৌক্তিক দাবির কারণেই সরকার এই অচলাবস্থার মুখে পড়েছে। অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অভিযোগ করেছেন, ডেমোক্রেটরা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য আমেরিকান জনগণকে জিম্মি করে রেখেছে। ভ্যান্স আরও বলেন, যদি এই শাটডাউন দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ফেডারেল কর্মীদের শুধু ছুটিতেই পাঠানো হবে না, বরং স্থায়ী ছাঁটাইও হতে পারে।
সিনেটে ডেমোক্রেট নেতা চাক শুমার বলেছেন, রিপাবলিকানরা অর্থায়ন পরিকল্পনা মেনে নিতে না চাওয়ার কারণে সরকার অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, রিপাবলিকানরা সমঝোতার বদলে ডেমোক্রেটদের ‘বুলি’ বা হয়রানি করছে। কানেকটিকাটের ডেমোক্রেট সিনেটর ক্রিস মারফি বলেছেন, রিপাবলিকানরা কখন আলোচনায় সিরিয়াস হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অন্যদিকে রিপাবলিকানরা দাবি করছে, স্বাস্থ্যসেবা বেনিফিট সম্প্রসারণের যে প্রস্তাব ডেমোক্রেটরা দিচ্ছে তা আমেরিকান করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। তাদের যুক্তি, এই ধরনের সুবিধাগুলো মূলত কোভিড-১৯ মহামারির সময় চালু হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এর প্রযোজ্যতা নেই। হোয়াইট হাউজের বাজেটবিষয়ক প্রধান রাসেল ভটও রিপাবলিকানদের ক্লোজড ডোর বৈঠকে জানিয়েছেন, ছাঁটাই কেমন হতে পারে তা নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে, যদিও জনসাধারণের কাছে সে বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়নি।
শাটডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ফেডারেল কর্মীরা। প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মী অর্থাৎ প্রায় সাত লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষকে সাময়িকভাবে ছুটিতে পাঠানো হতে পারে। অনেকে ইতিমধ্যেই বুধবার থেকেই ছুটিতে গেছেন। অপরিহার্য সেবায় নিয়োজিত যেমন সেনা, সীমান্ত রক্ষী কিংবা জরুরি এজেন্টদের বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এর ফলে পরিবার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৮ সালের শাটডাউনের তুলনায় এবারের সংকট অনেক বড় হতে যাচ্ছে। তখনও কংগ্রেস আংশিক তহবিল অনুমোদন করেছিল, কিন্তু এবার সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি অভিযোগে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। ডেমোক্রেটরা বলছে, নিম্ন আয়ের আমেরিকানদের স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তার জন্যই তারা আপস করছে না। রিপাবলিকানরা বলছে, সরকারের কার্যক্রম চালু রাখাই তাদের মূল লক্ষ্য, তবে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে কেন্দ্র করে ডেমোক্রেটরা অতিরিক্ত ব্যয় চাপাচ্ছে। হাউজের স্পিকার মাইক জনসন বলেছেন, আলোচনার কিছু নেই, কারণ বিল থেকে কিছু বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। শুক্রবার রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত স্বল্পমেয়াদী অর্থায়ন বিলের ওপর আবার ভোট হওয়ার কথা রয়েছে, তবে তাতেও সমাধান হবে কিনা তা অনিশ্চিত।
এই অচলাবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে যখন ফেডারেল সংস্থাগুলো দীর্ঘ সময় কার্যক্রম স্থবির অবস্থায় থাকবে। এতে লাখ লাখ মানুষের আয় বন্ধ হয়ে যাবে, যার প্রভাব বাজার ও ভোগব্যয়েও পড়বে। একইসাথে আন্তর্জাতিক মহলেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমন এক সময়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি নানা চাপে রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনও এই শাটডাউন প্রসঙ্গে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, যদি শাটডাউন দীর্ঘায়িত হয় তাহলে শুধু সাময়িক নয়, স্থায়ী ছাঁটাইও হতে পারে। তাঁর মতে, অনিবন্ধিত অভিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা বাড়াতে চাওয়াই ডেমোক্রেটদের আসল উদ্দেশ্য, আর সেই কারণেই তারা বাজেট সমঝোতা করতে চাইছে না। তবে ডেমোক্রেটরা এই অভিযোগ একাধিকবার অস্বীকার করেছে। হাউজ মাইনরিটি লিডার হাকিম জেফরিস বলেছেন, ফেডারেল আইন পরিবর্তন করে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কোনো প্রস্তাবই তাদের নেই।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অচলাবস্থা শুধু দুটি দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনমনীয়তার চিত্রই প্রকাশ করছে না, বরং গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। কংগ্রেসে দুই দলের এমন তীব্র দ্বন্দ্বের ফলে সাধারণ নাগরিকদের জীবনে সরাসরি প্রভাব পড়ছে। একজন ফেডারেল কর্মীর পরিবার যখন বেতনের নিশ্চয়তা হারায়, তখন তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটও তৈরি করে। সন্তানদের পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা, গৃহঋণ পরিশোধ––সবকিছুতে ধাক্কা লাগে। ফলে রাজনীতির এ খেলা আসলে সাধারণ মানুষের জীবনকেই জিম্মি করে রাখছে।
ইতিহাস বলছে, আমেরিকার শাটডাউন কেবল দেশটির অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং বিশ্বজুড়েও প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের বাজেট সংকট বা অচলাবস্থা বিশ্ববাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় টান পড়ে, এমনকি ডলারভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থাতেও চাপ তৈরি হয়। এ কারণে এবারের সংকটকেও আন্তর্জাতিক মহল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
রাজনৈতিকভাবে এই শাটডাউন উভয় দলের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। রিপাবলিকানরা যদি সমঝোতা না করে শুধু অস্থায়ী সমাধান খুঁজতে থাকে, তাহলে জনমনে তারা দোষারোপের শিকার হতে পারে। আবার ডেমোক্রেটরা যদি স্বাস্থ্যসেবা ইস্যুতে অত্যধিক অনমনীয় হয়, তবে সেটিও তাদের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া আনতে পারে। আগামী নির্বাচনের আগে উভয় দলই জনমতের ভারসাম্য রাখতে চাইবে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা সহজ নয়।
অবশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শাটডাউন এখন শুধু এক প্রশাসনিক অচলাবস্থা নয়, বরং রাজনৈতিক দোষারোপ ও কৌশলগত হিসাব-নিকাশের এক জটিল মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এই সংকট কতদিন চলবে, কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কত বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা আসবে––এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও অনিশ্চিত। তবে নিশ্চিত হলো একটাই: রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের এই খেলায় সাধারণ জনগণই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, আর তাদের জীবনের স্থিতিশীলতাই আজ সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে।
আপনার মতামত জানানঃ