অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্রা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর এবার আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের জন্য কঠোর আন্দোলন শুরু করেছে। গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবীতে অনড় আন্দোলনকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে দেশটির বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। যা দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও সংকটময় করে তুলছে।
ইতিহাসের সবথেকে বড় অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এ সংকটের জন্য রাজাপাকসে ভাইদেরই দুষছেন দেশটির আন্দোলনকারীরা। তারা দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। কিন্তু সোমবার রাজধানী কলম্বোতে আন্দোলনকারীদের উপরে হামলা চালায় প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকরা। এরপরই ক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশের চেষ্টা করে
এ সময় বাড়ির মধ্য থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট দূর হয়নি। আন্দোলনকারীরা এখন প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসেরও পদত্যাগ দাবি করছেন, আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। তাহলে এটাই কি শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাশালী রাজাপাকসে পরিবারের শেষ?
কোভিড মহামারি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট এবং জ্বালানি, ওষুধ এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অভাব দেশটিকে গ্রাস করেছে। তীব্র লোডশেডিং এবং পেট্রোলের জন্য দীর্ঘ সারি দেশটির সাধারণ চিত্র। খাবারের দাম বাড়ছে। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে সবচেয়ে অশান্তি বিরাজ করছে। এর মূল দায়ভার বর্তেছে রাজাপাকসে পরিবারের ওপর।
রয়টার্স বলছে, তাই দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটার ছোট শহর ওয়েরাকেটিয়ায় ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দার পারিবারিক দুর্গসম ভিলাটিকেও রেহাই দেয়নি বিক্ষোভকারীরা। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তিনি সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শত শত লোক তার ভিলা পাহারা নিয়োজিত পুলিশ অফিসারদের ওপর হামলা করে।
ইতিহাসের সবথেকে বড় অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এ সংকটের জন্য রাজাপাকসে ভাইদেরই দুষছেন দেশটির আন্দোলনকারীরা।
তারা তার পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন এবং ক্রীড়া ট্রফিসহ বাড়িটি ভাঙচুর করে। বাড়ির প্রাচীরে লাল রঙে ‘গোটা গো হোম’ গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। মাহিন্দার বেডরুমের জানালাগুলোও ভেঙে চুরমার করা হয়েছে।
অর্ধডজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং পুলিশ অফিসারদের সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, রাজাপাকসেদের সম্পত্তি ধ্বংস করার জন্য সোমবার রাতে বিক্ষোভকারীদের প্রথম টার্গেট ছিল ভিলাটি। হামলার সময় এই পরিবারের কোনো সদস্য বাড়িতে ছিলেন না।
ওই পরিবারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এরকম তাণ্ডব আগে দেখিনি। হামলায় আহত আমার সহকর্মীরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সাহসও পাননি। কারণ চিকিৎসক এবং নার্সরা তাদের দেখলে খেপে যাতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল তাদের।’
দীর্ঘ দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে রাজাপাকসে পরিবার। পরিবারের বড় কর্তা মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে এত দিন ক্ষমতা সামলে আসলেও আন্দোলনের মুখে ঠিক এভাবে হুট করে তাকে যে প্রস্থান করতে হবে তা কেও ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি। অন্যদিকে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসা ছোট ভাই গোতাবায়া ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকলেও হুট করে বড় ভাইয়ের প্রস্থানে অনেকটাই একাকী হয়ে পড়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে অসীম দুর্নীতি আর মিথ্যা আশ্বাসে দেশটির ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা রাজাপাকসে পরিবারের কোনো সদস্যকেই আর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দেখতে চান না দেশটির সাধারণ জনগণ এবং রাজনীতিবিদরা। এমনকি রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য এবং তার দলীয় এমপিদের উপরও ক্ষুব্ধ দেশটির জনগণ।
মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই গোতাবায়াকে ক্ষমতা ছাড়তে চাপ দেওয়া শুরু করে বিরোধী দলগুলোও। গোতাবায়া নতুন করে নিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ গঠন করার আশ্বাস দিলেও তাতে কর্ণপাত করতে ইচ্ছুক নয় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে দেশটির আমজনতা।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর রাজাপাকসে পরিবারের জন্য প্রথম বড় ধাক্কা হয়ে আসে সব মন্ত্রী এবং দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হলেও কেও বেশি দিন টিকতে পারেনি। এমন অবস্থায় গোতাবায়া ও তার ভাই মাহেন্দ্রা ছাড়া তাদের আশেপাশে নিজের বলে কিছুই ছিলো না। শুরুতে মাহেন্দ্রা পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে একের পর এক অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত চলতি সপ্তাহের সোমবার হুট করেই নিজের পদত্যাগের ঘোষণা করেন মাহেন্দ্রা। তার পদত্যাগের পর বিক্ষোভকারীরা তার সরকারি বাসভবন ‘টেম্পল ট্রি’র উপর চড়াও হয়। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর তাকে তার সরকারি বাসভবন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে সেই রাতেই রাজাপাকসে পরিবারের পৈর্তৃক বাড়িতে হামলা চালিয়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
দিন যতই পার হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের টিকে থাকা অনেকটাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। তার সবচেয়ে বড় কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। প্রধান বিরোধীদলগুলো রাজাপাকসে পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া গোতাবায়া। তিনি দুই দফায় দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। নিজের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে যে কোনো উপায়েই হোক এই সংকট থেকে দেশকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন। এমনকি বিরোধীদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তাতে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। আবার বিরোধীদেরও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই তারা নিজেরাও সরকার গঠন করতে পারছে না। এমন রাজনৈতিক সংকটই দেশটিতে সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে। আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন প্রেসিডেন্টের উপরে। তবে এখনো গদি আঁকড়ে ধরে আছেন গোতাবায়া।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ