আফগানিস্তানে ১৫ বছর ধরে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের আফিম, হেরোইন ব্যবসা থেকে তালিবানের মুনাফা অর্জন বন্ধ করা। এই অভিযানে পপি চাষ নির্মূল থেকে শুরু করে সন্দেহভাজন ল্যাবে বিমান হামলাও চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এখনো গোটা বিশ্বে আফিমজাত মাদকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তালিবানরাই।
দীর্ঘ দুই দশক পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আবারও এসেছে তালিবান। বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে তারা গত মাসে পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে কতটা কার্যকর হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞা?
এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজ। তাদের একটি দল চষে বেড়িয়েছে পপি চাষের মূল কেন্দ্র হেলমান্দ এবং কান্দাহার অঞ্চলে।
লমান্দের প্রত্যন্ত শহর মুসা কালা। সেখানকার ব্যস্ত একটি মার্কেটে প্লাস্টিক ব্যাগে প্রকাশ্যেই বেচা হচ্ছে আফিম, অনেকটা শাকসবজি বিক্রির মতো। অন্যপাশে চলছে ফসল কাটার কাজ।
কিছুদিন আগেও তালিবানের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই মুসা কালা শহর। আফগানিস্তানের অন্যসব গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মতো এখানে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব প্রবল। এই অঞ্চলে বাড়ির বাইরে নারীর দেখা মেলা ভার।
আফিম ব্যবসা এই অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমন না যে কোনো মাফিয়া চক্র এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ বাসিন্দারাই এই ব্যবসায় জড়িত। এদের অনেকে সচ্ছল, অনেকে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। যুবক, বৃদ্ধ এমনকি তালিবান… সবাই বেচছে আফিম।
মুসা কালার কাছে ঘান্দেই গ্রামের বাসিন্দা ইজবুল্লাহ। ২৮ বছরের ইজবুল্লাহ একটি পপিক্ষেতের মালিক। দিন শেষে শ্রমিকদের দেখতে এসেছেন তিনি।
ভাইসকে ইজবুল্লাহ বলেন, ‘এখানে এমন কোনো পরিবার নেই, যার অন্তত একজন সদস্য পপি ক্ষেতে কাজ করছেন না।
‘নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কয়েক দিন পর তালিবানরা বাড়ি বাড়ি এসে আমাদের জানায়, আপাতত ফসল কাটুন। তবে পরবর্তীতে এসব বন্ধ করতে হবে।’
মসজিদ এবং বাজারেও ফলাও করে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি প্রচার করে তালিবান। তবে আফিমসহ অন্যসব মাদকের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়।
এর আগেও পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তালিবান, সেটা ২০০০ সালে। তবে তা কার্যকর ছিল কেবল এক মৌসুমে। নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর নিয়ে কৃষকরা সন্দিহান।
গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতা নেয়ার আগেও পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু চাষিরা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে চালিয়ে যেতেন চাষাবাদ।
এখন প্রশ্ন হলো, এতসব সতর্কতা ও জনসংযোগের মধ্যেও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক তালিবানরা? কারণ পপি চাষ ছাড়া কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে খোদ তালিবানরাও।
‘নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কয়েক দিন পর তালিবানরা বাড়ি বাড়ি এসে আমাদের জানায়, আপাতত ফসল কাটুন। তবে পরবর্তীতে এসব বন্ধ করতে হবে।’
আফগানিস্তানের জিডিপির ১১ শতাংশ আসে আফিম থেকে। অনেকেই মনে করছেন, পশ্চিমাদের বাহবা পেতে এই আয় হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছে তালিবানরা।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় বিপাকে আছেন কৃষকরা। তারা কাজ হারানোর পথে। আফিম চাষে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন। এই চাষ বন্ধ হলে জমির মালিকরা অন্য ফসল চাষে ঝুঁকবেন। অনেক কৃষক কাজ হারাবেন। তাদের বাড়ি বা জমি থাকবে না।
গত শুক্রবার ঈদের ছুটির আগে এক বার্তায় তালিবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা পপি চাষের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করেন। তবে এখন যেসব জমিতে পপি চাষ হচ্ছে, এসবের কী হবে তা স্পষ্ট করেননি তালিবানপ্রধান।
ওই বার্তায় আফগান জনগণ বিশেষ করে কৃষকদের বিকল্প জীবিকা ও চাষাবাদের সন্ধান করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন আখুনজাদা।
অতীতেও এমন আহ্বান এসেছিল তালিবানের পক্ষ থেকে। তবে বিকল্প ফসল চাষে তেমন আগ্রহ দেখায়নি আফগানরা। এ ছাড়া নতুন ফসল চাষে অর্থায়ন করতে পর্যাপ্ত তহবিলও নেই তালিবানের হাতে। তারা বিদেশি টাকা আসার বিষয়ে বাজি ধরছে।
আফগনিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ। হেরোইন তৈরিতে এই আফিম প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে যে পরিমাণ হেরোইন যায়, এর ৯৫ শতাংশই আফগানিস্তান থেকে যায়। ।
আফগানিস্তানে আফিমের চাষ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তারপরও দরিদ্র কৃষকরা অর্থের জন্যে এই পপি চাষে উৎসাহিত হন।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে দেশটির আফিম উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। পপি চাষ বন্ধ করার জন্য চাষীদের নানা ধরনের বিকল্প পণ্য যেমন আনার ও জাফরান চাষের জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার পরও এই অবস্থা।
পপি চাষে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র কান্দাহার প্রদেশ। হেলমান্দের পর এর অবস্থান। কান্দাহারের ২ একর জমিতে পপি বুনেছিলেন ৩৫ বছর বয়সী কৃষক মোহাম্মদ নাদির। রয়টার্সকে তিনি বলেন, গম বা অন্যান্য ফসল চাষ করলে তাদের যথেষ্ট লাভ হয় না। তার ক্ষেতে চাষ করা পপি থেকে আয় হবে ৩ হাজার ডলার। অথচ ওই একই জমিতে যদি তিনি গম চাষ করতেন তাহলে তার আয় হতো ১ হাজার ডলার কম। যদিও পপি চাষ করে পাওয়া টাকা তিনি একাই নিতে পারবেন না। জমি রক্ষা করার জন্য তালিবান ও মাদক বিক্রির জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদেরকে ভাগ দিতে হবে।
কাবুলের পতনের পর গোটা আফগান অর্থনীতিতে চরম মাত্রায় ধস নেমেছে। আসন্ন দিনগুলোয় দেশটিতে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। গৃহযুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে দেশটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। অদূরভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়া এ আফগান নাগরিকদের দুরবস্থার সুযোগ নিতে পারে তালিবানরা। তাদের নিয়োজিত করা হতে পারে মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যের সঙ্গে।
এছাড়া আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে বৈদেশিক অনুদাননির্ভরতা অনেক বেশি। তালিবানদের কাবুল দখলের পর এ অনুদানের বড় একটি অংশ বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তালিবানরা আয়ের জন্য নিশ্চিতভাবেই মাদক বাণিজ্যের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিনদের এসব উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। আফিম চাষের ওপর নির্ভরশীল আফগান কৃষকদের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে গিয়েছে কাবুলের সরকার ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকরা। এ আফিমচাষী কৃষকরা শেষ পর্যন্ত তালিবানদেরই অনুগত হয়ে উঠেছেন।
ইনডিপেনডেন্ট কনসালটেন্ট ডেভিড ম্যানসফিল্ড দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ জীবিকা নিয়ে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আফিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অলৌকিক ফসলের অনুসন্ধান বেশ কঠিন। গত ২০ বছরের প্রমাণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আফিম থেকে সরানোর জন্য কৃষকদের উন্নত নিরাপত্তা, শাসন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাকতালীয় অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।
অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, তালিবান কেবল বিদেশি আর্থিক সাহায্য টানার জন্য নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করছে।
এ প্রসঙ্গে ম্যানসফিল্ড বলেন, ‘সমালোচকরা এই নিষেধাজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে পারে। তবে তালিবানকে অর্থায়ন করা পশ্চিমাদের ভুল সিদ্ধান্ত হবে।
‘আফগানিস্তানে এর আগে অনেকবার এমনটা করা হয়েছে। তবে এটি কখনই ভালোভাবে শেষ হয় না। মাদক ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞার জন্য ‘তাড়াহুড়ো বা চাপ প্রয়োগ করা উচিত না। নতুন সরকার এমন একটি কৌশল বেছে নিয়েছে যা জনগণকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০২
আপনার মতামত জানানঃ