চলতি বছরের রমজান মাসেও ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশটির পুলিশ ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী। ইসরায়েলি বাহিনীর এ হামলায় ৪২ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
রমজান মাসের শেষ শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) জুমার দিন এ তাণ্ডব চালানো হয় বলে জানা গেছে। ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট শাখা জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে ২২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ইসরায়েলের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবারের জুমার নামাজ শুরুর বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই আল আকসা চত্বরে জড়ো হতে থাকেন মুসল্লিরা। এ সময় অনেকটা আকস্মিকভাবেই সেই জনসমাগম থেকে কয়েকজন ইসরায়েল বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন।
পরিস্থিতি শান্ত করতে চত্বরে পুলিশ ঢুকলে উত্তেজনা আরও বাড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিকে পাথর ও পটকা ছোড়া শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তারা আল আকসা মসজিদের নিকটবর্তী ইহুদিদের পবিত্র তীর্থস্থান ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দিকেও পাথর-পটকা ছুড়তে থাকেন তারা।
বিক্ষোভকারীদের হটাতে টিয়ারগ্যাস, লাঠি ও রবার বুলেট ব্যবহার করে পুলিশ। এতে আহত ৪২ জনের মধ্যে ২২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট শাখা। আহতদের বেশিরভাগই দেহের উর্ধ্বাংশে আঘাত পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিক্ষোভে উস্কানি দেওয়ারে অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে ৩ জনকে আটক করেছে ইসরায়েলের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে এবং তারপর আল আকসা চত্বরে জুমার নামাজও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ মুসল্লিদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে টিয়ার শেল ছোড়ে ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে ইসরায়েলি পুলিশ।
মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন আরও বেড়েছে আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে। গত দুই সপ্তাহে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সহিংসতায় অন্তত তিনশ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।
বিক্ষোভকারীদের হটাতে টিয়ারগ্যাস, লাঠি ও রবার বুলেট ব্যবহার করে পুলিশ। এতে আহত ৪২ জনের মধ্যে ২২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট শাখা। আহতদের বেশিরভাগই দেহের উর্ধ্বাংশে আঘাত পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
আল আকসা চত্বরে ইসরায়েলের ইহুদি সেটলারদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়াকে সাম্প্রতিক এই সংঘাতের মূল কারণ বলে আল জাজিরাকে জানিয়েছে জেরুজালেম ইসলামি ওয়াকফ। কর্মকর্তারা বলেন, গত সপ্তাহে ইহুদিদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ‘নিস্তারপর্ব’ উপলক্ষে চত্বরে জড়ো হয়েছিলেন অন্তত ৩ হাজার ৭০০ ইসরায়েলি সেটলার।
মুসলিমদের তৃতীয় ধর্মীয় তীর্থস্থান আল আকসা মসজিদ। ইসরায়েলের ইহুদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের চুক্তি অনুযায়ী, আল আকসা মসজিদ চত্বর কেবল মুসলিমদের থাকবে। জেরুজালের প্রধান রাব্বি’র (ইহুদি ধর্মীয় নেতা) দপ্তর থেকেও বলা হয়েছে, আল আকসা চত্বরে ইহুদিদের উপাসনা নিষিদ্ধ।
ইসরায়েলের অর্থোডক্স ইহুদিরা এই নীতি মেনে চললেও দেশটিতে বাড়তে থাকা জাতীয়তাবাদী ইহুদি সম্প্রদায় এই নীতির বিরুদ্ধে। তাদের দাবি, আল আকসা চত্বরের একাংশে ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগ নির্মান করা হোক।
ফিলিস্তিনিরা এই দাবির তীব্র বিরোধী এবং আল আকসার সাম্প্রতিক সংঘাতের শুরু এই থেকেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস এলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইসরায়েল। চলতি বছরের পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজেন জাবারি আল-জাজিরাকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে তা বড় ধরনের বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত।
গত বছর জেরুজালেমে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন্দ্র করে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনিদের ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনজুড়ে।
এ বছরের মতো ঠিক গতবারও আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবেশ ও অভিযান আগে থেকেই চলে আসা দুই পক্ষের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ওই অভিযানের চার দিন পর গাজায় টানা ১১ দিন স্থল ও বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় কয়েক শ মানুষ হতাহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ ছিল শিশু। হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গাজার বাড়িঘরসহ বহু স্থাপনা। বাদ পড়েনি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ঘটনা নিয়ে ইসরায়েল বলেছিল, হামাসের রকেট ছোড়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা গাজায় অভিযান চালিয়েছে মাত্র।
গত রমজানের সংঘর্ষের পর সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা এবার ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের আরেকটি লড়াইয়ের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাজেন জাবারি বলেন, এবারের সংঘর্ষ শুধু যে জেরুজালেমের দিক থেকে শুরু হতে পারে তা নয়, বিভিন্ন দিক থেকেই শুরু হতে পারে। যেমন জেনিনে (পশ্চিম তীরের শহর) বিস্তর সংঘর্ষ হতে পারে। কারণ ইসরায়েল ওই শহরে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামার কথা বলতে পারে তারা।
গত ২২ মার্চ থেকে ইসরায়েলের ভেতরে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের হামলা বা ‘সশস্ত্র অপারেশন’ বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন ইসরায়েলি তিন পুলিশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৩৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এমনটাই জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ জেনিনে দুজন নিহত হন। সে সময় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের তেল আবিব ও বেনি বারেক শহরের কাছে হামলা চালান। আগের দিন পশ্চিম তীরে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর ও এক আইনজীবীকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
জেনিনের শরণার্থীশিবিরে বড় ধরনের ইসরায়েলি আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ, সেখানে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) ও ফাতাহ আন্দোলনের সশস্ত্র শাখার সদস্যরা সক্রিয়।
সংঘর্ষ শুরুর আভাস আসছে পিআইজের দিক থেকেও। ১০ এপ্রিল এই গ্রুপের এক মুখপাত্র হুঁশিয়ারি দেন, যদি ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনের শরণার্থীশিবিরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবে খুব শিগগির তাদের দিক থেকেও চূড়ান্ত জবাব আসবে।
গাজার শাসনক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আবার লড়াইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদি ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা আল-আকসা মসজিদ নিয়ে তাদের অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়ে যেতে থাকেন, তবে হামাস বসে থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৭
আপনার মতামত জানানঃ