মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের ধর্ষণের অভিযোগ প্রায় নিয়মিত খবরে দাঁড়িয়ে গেছে। মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের এহেন ধর্ষণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দেশ। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়ে মানুষের মনেও জন্মেছে নেতিবাচক মনোভাব। এসব খবরের মধ্যে ইতিমধ্যে শোনা গেলো চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনায় মাসুমা জান্নাত মহিলা মাদ্রাসার ৩য় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ওই মাদ্রাসার সুপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) দুপুর ১২ টার দিকে ওই মাদ্রাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ওই সুপারের নাম মুফতি গোলাম কিবরিয়া (৬২)। তিনি দর্শনা পৌর এলাকার মোহাম্মদপুরের মৃত হায়দার আলীর ছেলে ও দর্শনা ওলামা পরিষদের সভাপতি।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওই ছাত্রীর বাবার মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে মুফতি গোলাম কিবরিয়াকে আটক করে দর্শনা থানা পুলিশ। দুপুরে মুফতি গোলাম কিবরিয়াকে একমাত্র আসামি করে ধর্ষণ মামলা করা হয়। পরে পুলিশ ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে পাঠায়। ওই ছাত্রীকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আগামী রোববার তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর পিতা সংবাদমাধ্যমকে জানান, সুপার মো. গোলাম কিবরিয়া কয়েকদিন আগে আমার মেয়েকে (১১) ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। মেয়ে ভয়ে আমাদের না জানালেও বিষয়টি তার সহপাঠীদের মাধ্যমে জানতে পারি। পরে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টার দিকে দর্শনা থানায় নারী ও শিশু ধর্ষণ নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করি।
ওই ছাত্রীর মা বলেন, গোলাম কিবরিয়া কয়েকদিন আগে আমার মেয়েকে (১১) ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। মেয়ে ভয়ে আমাদের না জানালেও বিষয়টি তার সহপাঠীদের জানায়। পরে সেই সহপাঠীদের অভিভাবকের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারি আমরা। এখন আমার মেয়ে সমাজে কীভাবে মুখ দেখাবে? আমরা ওই হুজুরের ফাঁসি চাই।
মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুল্লাহ বলেন, আমি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আজ সকালে পুলিশ হুজুরকে থানায় নিয়ে গেছে। ভুক্তভোগী ছাত্রী মাদ্রাসায় থেকে পড়াশোনা করত। সে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
স্থানীয়রা জানান, এর আগেও এই হুজুরের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল।
স্থানীয়রা জানান, এর আগেও এই হুজুরের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল।
দর্শনা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএইচ এম লুৎফুর কবির বলেন, ওই ছাত্রীর বাবার দায়ের করা ধর্ষণ মামলায় মাদ্রাসার পরিচালক গোলাম কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতের বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এলাকার মানুষ মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। একটা সময়ে হয়তো এসব কুকর্মের কথা বাইরে প্রচার হতো না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ, আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা যাতে বিচার থেকে রেহাই পেতে না পারে, সে ব্যবস্থা করা গেলে শিশুদের অনেকাংশে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। তবে এসবের বাইরেও কিছু ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের মাথা বিক্রির কথা। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে না চাওয়ার কথা। দেশ, সমাজ আর শিশুদের আপন না ভাবার আত্মপ্রতারণার কথা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ