পটুয়াখালীর দশমিনা থানায় এক যুবককে হত্যার অভিযোগ করেছে তার পরিবার। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, ওই যুবককে থানায় আটক রাখা হলে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু নিহতের পরিবার বলছে, তার কাছে তখন বিষ থাকার কোনো সুযোগই নেই। লিটন খাঁ নামে নিহত ওই যুবককে পুলিশ ধরে এনেছিল দখলদারদের অভিযোগের ভিত্তিতে। মাদ্রাসার নামে জমি দখলে লিটন বাধা দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশের দাবি, নিহত যুবক লিটন খাঁর পকেটে একটি চিরকুট মিলেছে। যা থেকে বোধ হতে পারে যে, তিনি আত্মহত্যাই করেছেন। ওই চিঠিতে লিটন মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। চিরকুটে লেখা আছে, ‘আমার জমি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা সুপার মাওলানা সিহাব উদ্দিন ও স্থানীয় মকবুল খানের ছেলে মো. মফিজ খান ১ লাখ টাকা দাবি করেছে। আমি টাকা দিতে না পারায় বিভিন্ন সময় মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে ও আমার পরিবারকে হয়রানি করছে। তাই আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।’
তবে লিটনের পরিবারের সন্দেহ, পুলিশও এই হত্যার সঙ্গে যুক্ত। লিটন মারা যাওয়ার পর এরকম চিরকুট পুরে দেয়া উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। চিঠির ভাষ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। হতে পারে ঘটনার গতিপ্রবাহ মাদরাসা কর্তৃপক্ষের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ। বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আলাউদ্দিন খানের ছেলে লিটন খানের বয়স মাত্র ৩৫। লিটনের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, ‘দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় পুলিশ লিটনকে ধরে নিয়ে যায়। সে সময় লিটন গেঞ্জি গায়ে ছিল, বিষ পেল কোথায়। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।’
জানা যায়, রজ্জবিয়া মাদ্রাসার সুপার সিহাব উদ্দিন ও স্থানীয় বাসিন্দা মফিজ খান মিলে লিটনের ৪৪ শতাংশ জমি মাদ্রাসার নামে দখল করে রেখেছিলেন। ওই জমিতে এক সপ্তাহ আগে লিটন ঘর তোলেন। এ ঘটনায় সিহাব উদ্দিন গত রবিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ফেরদৌস বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। পরে ইউএনও থানা পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ৬ ডিসেম্বর ২০২০, রবিবার বিকেলে দশমিনা থানার এএসআই মামুন লিটনকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন।
থানা হাজতে লিটন খাঁ অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রাতে তাকে পুলিশ পাহারায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিববার রাত ১টার দিকে তিনি মারা যান। শেবাচিম হাসপাতালের মর্গে লিটনের পরিবার সাংবাদিকদের বলছেন, পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়েছে। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছেন। তবে পুলিশ বিষয়টিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছে। ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
লিটন খাঁ ঢাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। তার তিনটি সন্তান রয়েছে। লিটনের স্ত্রী মাজেদা বেগম সাংবাদিকদের জানান, বাড়ির পাশেই আক্রাম খান সিনিয়র দাখিল মাদরাসা। জমি নিয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। গত শনিবার রাতে মাদরাসা সংলগ্ন ওই জমির একটি পুকুরে কে বা কারা বিষ প্রয়োগ করে। এতে ওই পুকুরের মাছ মরে ভেসে ওঠে। পুকুরে বিষ দেয়ার ঘটনায় মাদরাসা সুপার মাওলানা সিহাব উদ্দিন তার স্বামী লিটনকে সন্দেহ করেন। তবে ওই সময় লিটন ঢাকায় ছিলেন।
লিটনের স্ত্রী মাজেদা বেগম বলেন, এরপর মাদরাসা সুপার লিটনের নামে দশমিনা থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। পরে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জমি নিয়ে বিবদমান সমস্যা সমাধানের কথা বলে ফোনে লিটনকে বাড়িতে আসতে বলেন। তিনি আরো জানান, রবিবার তার স্বামী ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। রাতে থানা পুলিশ জানায়, তার স্বামী অনেক অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সকালে (সোমবার) জানতে পারি, আমার স্বামী মারা গেছে। থানায় নেয়ার সময় লিটন সুস্থ ছিলেন বলে দাবি করেন তার স্ত্রী মাজেদা বেগম। তিনি আরো বলেন, তার শরীরে কোনো রোগ ছিল না। হঠাৎ করে কীভাবে মৃত্যু হলো তা পুলিশই ভালো বলতে পারবে। আমি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।
এই ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। মাদরাসা সুপার ও পুলিশ-প্রশাসনকেই দুষছে সাধারণ মানুষ। এলাকার বৃদ্ধ ভ্যানচালক আসলাম মিঞা বলেন, ‘এরা সব ক্ষ্যামতাওলা লোকজন এক হইছে। পোলাডারে মাইরা ফালাইলো। এখন হের তিনডা বাচ্চা লইয়া বউডা কী করব, আহারে। দেশে তো আর বিচার আচার কিছু নাই। পুলিশের লগে কতা কওন যায় না।’
দশমিনা থানার ওসি মো. জসিম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, মাদরাসা কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে লিটন খাঁ নামের ওই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। দুই পক্ষকে নিয়ে থানায় কথা হচ্ছিল। এরই মধ্যে এশার নামাজের বিরতি দেয়া হয়। তখন থানার বাথরুমে যান লিটন। এর পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তার হাতে একটি বোতল ছিল। ধারণা করা হচ্ছে তিনি বিষপান করেছেন। তাৎক্ষণিক লিটনকে দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার রাত ১টার দিকে লিটন মারা যান। থানায় কীভাবে বিষ এলে সে ব্যাপারে ওসি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি দাবি করেছেন, পুলিশ হেফাজতে তাকে মারধর তো দূরের কথা, লিটনের সঙ্গে কেউ দুর্ব্যবহারও করেনি।
দশমিনা ও গলাচিপা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, লিটন তার নিজের কাছে কীটনাশকজাতীয় তরল পদার্থ বোতলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। থানায় প্রবেশের কিছু সময় পর তিনি বাথরুমে যান। এরপর ওই তরল পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। থানায় কীভাবে বিষের বোতল নিয়ে যুবক প্রবেশ করলেন, সেন্ট্রি বা কারোর দায়িত্বে গাফিলতি ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্তকমিটি গঠন করা হয়েছে।
দশমিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ফেরদৌস জানান, মাদরাসা সুপার পুকুরের মাছ মারার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগটি সুপারিশ আকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানায় পাঠানো হয়েছে।
এসডাব্লিউ/এমএন/আরা/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ