বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে গত বছর ১৩ই মার্চ গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ওই অভিযান পরিচালনা করেন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন এবং সহকারী কমিশনার এস এম রাহাতুল ইসলামও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামের ওই সময়কার ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশেই আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয় বলে আরিফুলের পরিবারের অভিযোগ করেন।
মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আটকে নির্যাতন ও মিথ্যা অভিযোগে মোবাইলকোর্টের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। তবে এ অন্যায় ঘটনায় অভিযুক্ত সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন ও জেলা প্রশাসনের সাবেক তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি আজও।
বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত দুই বছরেও নিজের ওপর হওয়া নির্যাতন ও অন্যায়ের বিচার না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন নির্যাতিত সাংবাদিক আরিফ। তিনি বলেন, ‘আসামিরা ক্ষমতাশালী। এদের মধ্যে দুই জনকে ইতোমধ্যে পদায়ন করা হয়েছে। ফলে তারা বিভিন্নভাবে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্টে রিট করার পর আদালত রুল জারি করলেও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দুই জনকে পদায়ন করা হয়েছে। মামলা সমঝোতা করার জন্য আমাকে নানা মাধ্যমে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যেকোনও সময় আমার বড় ধরনের ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় আমি ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। নির্যাতনের শিকার হওয়া আমি প্রথম সংবাদকর্মী নই। সুষ্ঠু বিচার না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। তাই ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। যাতে দেশে আর কোনও সংবাদকর্মীকে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে না হয়।’
কুড়িগ্রাম সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলার পর থেকে বদলিজনিত কারণে এ পর্যন্ত তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মামলার কেস ডায়েরি (সিডি) আদালতে উপস্থাপনও করা হয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত পুলিশ প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
‘আসামিরা ক্ষমতাশালী। এদের মধ্যে দুই জনকে ইতোমধ্যে পদায়ন করা হয়েছে। ফলে তারা বিভিন্নভাবে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।’
জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি খান মো. শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গুরুত্বের সঙ্গে মামলার তদন্ত চলছে। এখনও আমাদের কাজ মেষ হয়নি। জেলা প্রশাসনের কাছে আমরা কিছু তথ্য চেয়েছি, সেগুলো এখনও পাওয়া যায়নি। সেসব তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত আমরা মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে পারছি না। যেহেতু মামলাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু আমাদের সিনিয়র স্যারেরা খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করবেন। এরপর আমরা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবো। এজন্য আরও কিছু সময় লাগবে।
তবে আর কতদিন সময় লাগবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
সাংবাদিক আরিফের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি। পুলিশ প্রবিধানমালা ১৯৪৩ এর ২৬১ প্রবিধান অনুসারে বিরতিহীনভাবে তদন্তকার্যক্রম চালালে সবচেয়ে জটিল মামলার তদন্ত শেষ করতেও ১৫ দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়। ইতোমধ্যে সাংবাদিক আরিফের ওপর নির্যাতনের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট (এমসি) তদন্ত কর্মকর্তা গ্রহণ করেছেন। আমরা প্রত্যাশা করি আইনের শাসনের স্বার্থে পুলিশ সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বচ্ছতার সঙ্গে অবশিষ্ট তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেবে।’
গত ২০২০ সালের ১৫ মার্চ অনলাইন নিউজপোর্টাল এর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়। তার বাড়িতে আধা বোতল মদ এবং গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এভাবে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন, আরডিসি বা রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং এনডিসি বা নেজারত ডেপুটি কালেকটর এস এম রাহাতুল ইসলাম। ঘটনার তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অসাদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সুলতানা পারভীনের দুই বছরের বেতন স্থগিত করা হয়। আরডিসি নাজিমকে এক ধাপ পদাবনতি দেয়া হয়। এনডিসি রাহাতুলের তিন বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয় এবং রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ওএসডি অবস্থায় রয়েছে।
পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টের কাছে শাস্তি মওকুফের আবেদন করেন সুলতানা পারভীন। প্রেসিডেন্টের সুপারিশক্রমে সুলতানা পারভীনের দন্ড মওকুফ করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সুলতানা পারভীন বর্তমানে ওএসডি অবস্থায় আছেন।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম বলেন, ওই সময় সরকারের ঊচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে এবং ন্যায় বিচার পাব। কিন্তু এটাই যদি ‘ন্যায়বিচার’ হয় তবে সাধারণ জনগণের কাছে এ শব্দটি কল্পনাপ্রসূত শব্দ বলে মনে হবে। একটা প্রমাণিত অপরাধ প্রমাণিত হলো, বিভাগীয় তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেল। কিন্তু অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে গেল। এই ঘটনা সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেবে। এধরণের কর্মকর্তার কাছে রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে আছে- এমন বার্তা পাবে জনগণ।
আরিফুল বলেন, ঘরের দরজা ভেঙ্গে পরিবারের সদস্যদের গালিগালাজ করে সেই রাতে আমাকে তুলে নিয়ে যান আরডিসি নাজিম। ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট বসানো, মারধর করা, ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো এবং সবশেষে আমাকে কারাগারে নিয়ে যান তিনি। এই ঘটনার নির্দেশদাতা ছিলেন ডিসি সুলতানা পারভীন। অর্থাৎ মূল হোতা হলেন দুইজন। আমি পরবর্তীতে রিন্টু বিকাশ চাকমা ও রাহাতুলের নাম জানতে পারি।
বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন রিগান।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের ১০ মাস পর জেলা প্রশাসন আরিফুলের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাকে সাজা দেয়।
ওই ঘটনা তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়, বিষয়টি হাইকোর্টেও গড়ায়। পরে রিগানকে জামিন দেয় কুড়িগ্রামের আদালত। মুক্তি পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন রিগান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাত ও চোখ বাঁধা’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পর তাকে ‘বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন’ করা হয়। চোখ বেঁধে তার কাছ থেকে স্বাক্ষরও নেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে কুড়িগ্রাম থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
পরে, ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ডিসি সুলতানা পারভীন, সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারসহ ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফুল।
হাইকোর্ট ওই অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ডের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে দেওয়া সাজা স্থগিত করে।
এর পর ২৬ মার্চ সুলতানা পারভীনসহ তার কার্যালয়ের সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি এবং ন্যায়বিচারের প্রতি এমন উদাসীনতা নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ইতোমধ্যেই ক্রমবর্ধমান পুলিশিংয়ের মধ্যে কাজ করছে। তাদের মাথার ওপর ভয়ংকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ঝুলছে। বর্তমানে যে ভয়ের পরিবেশে সাংবাদিকরা কাজ করছে এই ধরনের পরিস্থিতি সেই ভয় আরও বাড়িয়েছে।
আরও বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে এই ধরনের হামলার ঘটনা বাড়বে এবং স্বাধীন ও সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষ পর্যন্ত এটা শুধু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপরই নয়, গণতন্ত্রের ওপরও আক্রমণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৪
আপনার মতামত জানানঃ