মহাকাশ অভিযানের সার্থকতা সম্পর্কে যারা প্রশ্ন তোলেন, হাবল টেলিস্কোপের কাহিনি তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত৷ প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে মহাকাশের এই চোখ একের পর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার করে চলেছে৷
এ পৃথিবী থেকে বহুদূরে, এত দূরে যে দূরত্ব কল্পনা করাও মুশকিল, ৩২ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আলোর গতিতে গেলেও সেখানে পৌঁছাতে ৩২ কোটি বছর সময় লেগে যাবে, সেই খানে ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য এক ঘটনার অবিশ্বাস্য ছবি তুলেছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। খবর স্পেসডটকম।
অ্যানড্রোমেডো নক্ষত্রপুঞ্জের একটি ঘটনার ছবি তুলেছে হাবল। সেখানে মহাকর্ষীয়বলে ক্ষয়িষ্ণু দুটি ছায়াপথের (গ্যালাক্সি) এমন স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি তুলেছে হাবল, যাতে ছায়াপথ দুটির নড়াচড়াও ধরা পড়েছে।
যে দুটি ছায়াপথের ছবি হাবল তুলেছে তার একটি হলো স্মলার পোলার-রিং গ্যালাক্সি আইসি ১৫৫৯ ( ছবিতে উপরে) আর দ্বিতীয়টি হলো লার্জার স্পাইরাল গ্যালাক্সি এনজিসি ১৬৯ (ছবিতে নিচে)। হ্যালটন আর্পের অ্যাটলাস অব পিকুইলার গ্যালাক্সিতে এ দুটি ছায়াপথকে একসাথে এআরপি ২৮২ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মধ্যাকর্ষণশক্তির মাধ্যমে একটি ছায়াপথের সাথে অন্য ছায়াপথের মিথস্ক্রিয়া হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। নাসার কর্মকর্তার একটি বিবৃতিতে লিখেছেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন মেনে নিচ্ছেন যে, একটি ছায়াপথের বিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সেই ছায়াপথটি অন্য কোনো ছায়াপথের সাথে কিভাবে মিথস্ক্রিয়া করছে। একটি ছায়াপথ অন্য ছায়াপথে মিশে যেতে পারে, একটির সাথে অন্যটির সংঘর্ষ হতে পারে। আবার একটি ছায়াপথ ঘেঁষে সেটিকে পার করেও চলে যেতে পারে অন্য একটি ছায়াপথ। এসব ঘটনার ওপর নির্ভর করে কেমন হবে ছায়াপথের গড়ন ও গঠন।
অ্যানড্রোমেডো নক্ষত্রপুঞ্জের একটি ঘটনার ছবি তুলেছে হাবল। সেখানে মহাকর্ষীয়বলে ক্ষয়িষ্ণু দুটি ছায়াপথের (গ্যালাক্সি) এমন স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি তুলেছে হাবল, যাতে ছায়াপথ দুটির নড়াচড়াও ধরা পড়েছে।
ত্রিমাত্রিক স্পেসের মধ্যে থেকে দুটি ছায়াপথের মিথস্ক্রিয়ার এমন পরিষ্কার ছবি তোলা কঠিন, যেখানে তাদের নড়াচড়াও দৃশ্যমান হয়। তবে এআরপি ২৮২-এর ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয়েছে কারণ কাকতালীয়ভাবে একেবারে ঠিকঠাক একটা অ্যাঙ্গেলে ছিল হাবল। আর সে কারণেই হাবলের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, নক্ষত্রগুলোর নড়াচড়া, একটি ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথের দিকে ধূলা এবং গ্যাসের ছুটে চলা।
ছায়াপথ দুটি যদি অন্য কোনো অ্যাঙ্গেলে কাত হয়ে থাকত, তবে হয়তো এই টেলিস্কোপ কোনোদিনই এত পরিষ্কার ছবি তুলতে পারতো না, যেখানে এভাবে নক্ষত্রগুলোর এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে ঢুকে পড়াটা ধরা পড়ে।
এছাড়া ছবিটা দৃশ্যমান আলোতেও তুলেছে হাবল। নাসা বলছে, আইসি ১৫৫৯ ও এনজিসি ১৬৯ দুটি ছায়াপথেরই অ্যাকটিভ গ্যালাকটির নিউক্লিই (এজিএন) রয়েছে, যার অর্থ হলো এদের কেন্দ্র চরম শক্তিতে পরিপূর্ণ। অন্য কথায় বলতে গেলে, ছায়াপথ দুটির সূর্যের চেয়ে অন্তত শতাধিক গুণ বড় একাধিক ব্ল্যাকহোল রয়েছে।
হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপর ভাসমান অবস্থায় মহাকাশের নির্ভেজাল দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছে৷ এমন কিছু ঘটনা সেটির চোখে পড়ছে, যা পৃথিবী থেকে দেখা অসম্ভব৷ মহাকাশের এই চোখ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লুকানো সৌন্দর্য আমাদের চোখের নাগালে নিয়ে এসেছে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে৷
অথচ দৃষ্টিশক্তির ত্রুটির কারণে এই মিশন প্রায় বানচাল হতে বসেছিল৷ এমন বিপর্যয়ের ফলে সেই টেলিস্কোপ দিয়ে শুধু অস্পষ্ট ছবি তোলা যাচ্ছিল৷ সৌভাগ্যবশত হাবল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যে সেটির ভুলত্রুটি মেরামত করা সম্ভব৷ মোট পাঁচ বার মহাকাশে সেই টেলিস্কোপে নতুন যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে৷
এর ফলে শুধু টেলিস্কোপের আয়ু বেড়ে যায়নি, মেরামতির কাজ চালানোর সুবাদে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত টেলিস্কোপ হয়ে উঠেছে৷ ছবির মানও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে৷ এই টেলিস্কোপের সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যার একাধিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে৷
যেমন হাবল টেলিস্কোপের তোলা ছবি দেখে জানা গেছে, যে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আরও দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়৷ হাবলের কল্যাণেই জানা গেছে যে মহাকাশের বয়স ১,২০০ থেকে ১,৩০০ কোটি বছর৷
হাবলের আগে মহাকাশের এত গভীরে উঁকি মারা সম্ভব হয় নি৷ সেই জ্ঞানের কল্যাণে গ্যালাক্সির বিকাশ আরও ভালোভাবে বোঝা গেছে৷ হাবল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বেশিরভাগ গ্যালাক্সির মাঝের অংশে বিশাল ভরসম্পন্ন ব্ল্যাক হোল বাসা বেঁধে রয়েছে৷
নক্ষত্রের জন্ম ও বিকাশ সম্পর্কেও নতুন তথ্য দিয়েছে হাবল টেলিস্কোপ৷ মহাজাগতিক ধুলার আড়ালে নক্ষত্রের জন্মের বিস্তারিত দৃশ্যও দেখা গেছে৷ নক্ষত্রের মৃত্যু সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা গেছে৷ হাবলের তোলা ছবি সাজিয়ে আলোড়নে ভরা সেই প্রক্রিয়া চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়েছে৷ পরের দিকে হাবল দূরের নক্ষত্রজগতের মধ্যে গ্রহগুলিও পর্যবেক্ষণ করেছে৷ এমনকি সেগুলির বায়ুমণ্ডলও পরীক্ষা করেছে৷
সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে মহাকাশে ভাসমান এই টেলিস্কোপ ২০২৫ সাল পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবে এবং আরও অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কার করবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৭
আপনার মতামত জানানঃ