দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে। এরইমধ্যে শোনা গেল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে একটি মাদ্রাসা থেকে এক শিশুর গলা কাটা দেহ উদ্ধারের চারদিনের মাথায় আরও এক মাদ্রাসাছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পাঁচলাইশে আলী বিন আবি তালিব (রাঃ) নামে একটি মাদ্রাসার পেছন থেকে মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বেলা ১১টার দিকে মো. আরমানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পাঁচলাইশ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নিহত আরমান নগরীর একই থানা এলাকার মির্জাপুলের আলী আব্বাসের ছেলে। সে ওই মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিল।
আব্বাস উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যায় মাদ্রাসা থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয়, আমার ছেলে নিখোঁজ। সারা রাত আমরা তাকে খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা থেকে ফোন দিয়ে বলে মাদ্রাসায় যেতে। মাদ্রাসায় এসে দেখি আমার ছেলের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর কয়েকদিন আগে মারধরের কারণে সে মাদ্রাসা থেকে চলে আসতে চেয়েছিল। ও সম্পূর্ণ হিফজ শেষ করেছে। মাত্র একমাস আগে রিভিশনের জন্য তাকে ওই মাদ্রাসায় দেয়া হয়েছিল।’
আরমানের সহপাঠী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, মাগরিবের ১০ মিনিট আগে ও ছাদে গেছে, আর ছাদ থেকে নামে নাই।’
পরিদর্শক সাদেকুর বলেন, ‘খবর পেয়ে বেলা ১১টার দিকে মাদ্রাসার পেছন দিক থেকে আরমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার এক হাত ভাঙা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে একটি মাদ্রাসা থেকে এক শিশুর গলা কাটা দেহ উদ্ধারের চারদিনের মাথায় আরও এক মাদ্রাসাছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এর আগে শনিবার বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নের আল্লামা শাহ আছিয়র রহমান হেফজখানা ও এতিমখানা থেকে ইফতেখার মালেকুল মাশফি নামে এক শিশু ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় তার গলা কাটা দেহ পাওয়া যায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, এদিন সকালে মাদ্রাসায় সবক (তালিম) দেয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল মাশফি।
এ ঘটনায় করা মামলায় মাদ্রাসার শিক্ষক আবু জাফরকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া মাশফি হত্যায় আরও দুই শিক্ষকের সরাসরি সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাদের অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে।
দেশে নারীর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের চেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটছে মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা। প্রায় প্রতিদিনই মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের খবর আসে। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণে কেবল মাদ্রাসা শিক্ষককেরাই জড়িত থাকে না, মাদ্রাসার বড় ভাইদেরও লালসার শিকার হন মাদ্রাসায় আগত শিশুরা। বড় ভাইয়ের যৌন নির্যাতন থেকে নিরাপদ থাকা এইসব বাচ্চাদের জন্য অনেকটাই জটিল। এসব হত্যায় এসমস্ত বড় ভাইদের হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লেখক সাইফুল বাতেন টিটো। মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিয়ে গবেষণা করে তিনি ‘বিষফোঁড়া’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এসব হত্যা বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্টেটওয়াচকে জানান, মাদ্রাসার শিশু বলে আজ এই ধর্ষণ হত্যা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না, কারণ শিশুটি মাদ্রাসার। প্রায়ই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে মাদ্রাসায়। সেসব নিয়ে কোথাও কোনো কথা শোনা যায়নি। কিন্তু যখন আনুশকাকে হত্যা করা হলো তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, পথে দাঁড়িয়েছিলাম, টক শোতে টেবিল ফাটিয়েছিলাম। সেইসবের বিরোধীতা করছি না অবশ্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ যত হবে ততই ভালো। কিন্তু এই সব মাদ্রাসার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলে না।
তিনি বলেন, আমরা গরীবের শিশু হত্যার জন্যও পথে নামতে দেখেছি, টক শোতে কথাও বলতে দেখেছি। বড় বড় কলামিস্টদের কলাম পড়েছি। কিন্তু এই গরীব শিশুদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন ওসব হয় না? কারণ একটাই, ধর্ম। একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের দোষ গোপন করে চলেছে পরকালের ভয়ে। এখন প্রতিটি গ্রামে গড়ে তিনটা মাদ্রাসা। অর্থাৎ বিশাল কমিউনিটি এদের বিপক্ষে সরকার যেতে চায় না। তাদেরকে সরকার খুব ভয় পায়। তাদের চাপেই তো পাঠ্য বই থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা উধাও হয়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হোক। তারা কেন এবং কীভাবে মারা গেলো এবিষয়ে বিস্তারিত উদ্ঘাটন হোক। একইসাথে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৪
আপনার মতামত জানানঃ