২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপে ১০৯ টি নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনায় ২৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এসব সহিংসতায় আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে গত ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ভোটের দিনেই প্রাণ হারান কমপক্ষে ১২ জন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং নিজেদের সংগৃহীত উপাত্তের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। ১২টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিতসহ নিজেদের সংগৃহীত এসব তথ্যের বরাতে গতকাল সোমবার (৩১ জানুয়ারি) জানুয়ারি মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এর আগে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় আরও ৯২ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ। সব মিলিয়ে ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে মোট প্রাণহানি ঘটল ১২১ জনের।
কী উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় নিহত ২৯ জনের মধ্যে এক জন প্রতিপক্ষের গুলিতে এবং চার জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাত জন নিহত হয়েছেন বগুড়া জেলায়। এছাড়া ঝিনাইদহ জেলায় পাঁচ জন, চাঁদপুর জেলায় তিন জন এবং নরসিংদীতে দুই জন মারা গেছেন।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি বগুড়ার গাবতলীর একটি কেন্দ্রে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীর ফলাফল ঘোষণা নিয়ে দায়িত্বশীলরা গড়িমসি করায় বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা কেন্দ্র ভাঙচুর করেন এবং বিজিবি, পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে হামলা চালান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি গুলি চালালে চার জন মারা যান।
একই দিন মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলায় ভোটকেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার দৃশ্য দেখে সুমেলা খাতুন (৫০) নামে এক নারী স্ট্রোক করে মারা যান।
১২ জানুয়ারি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে নবনির্বাচিত এক ইউপি সদস্যের (মেম্বার) পৈশাচিক নির্যাতনে মারা গেছেন আনোয়ারুল ইসলাম (৩০) নামে এক তরুণ। তার এক হাতের সব নখ প্লায়ার্স দিয়ে তুলে ফেলা হয়, কেটে ফেলা হয় বৃদ্ধাঙ্গুল।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভাষ্যানুযায়ী, সহিংসতার বিচারে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনি এই সহিংস ঘটনার কারণে খোদ একজন নির্বাচন কমিশনার চলমান ইউপি নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহিংসতার দায় ভোটার ও প্রার্থীদের ওপর চাপিয়েছেন। আট ধাপে অনুষ্ঠেয় চলমান ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপ-পরবর্তী সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি তিন ধাপে এই সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর প্রথম দুই মাসে ছোটখাটো কয়েকটি সংহিস ঘটনা ঘটলেও কেউ মারা যায়নি। তবে গত বছরের মার্চ মাসে মারা যায় ১০ জন। পরে জুনে সেই সংখ্যা বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১ জনে।
সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে নভেম্বর মাসে। ওই মাসে নতুন করে ৫৬ জন-সহ ১১ মাসে মোট নিহত হয় ৮৭ জন। ডিসেম্বরে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২৬ জন। সব মিলিয়ে আসকের প্রতিবেদন মতে, গত বছর ইউপি নির্বাচনি সহিংসতায় মারা গেছে ১১৩ জন।
এ সময়ে ৬৭২টি সহিংস ঘটনায় সাত হাজার ২০১ জন আহত হয়। আসকের এই প্রতিবেদন তৈরির পরবর্তী সময়ে আরও ১৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চম ধাপের ভোটের দিনই নিহত হয় ১১ জন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪টিতেই প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বোচ্চ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাত জন নিহত হয়েছে কক্সবাজারে।
কেন এত প্রাণহানি?
এমএসএফ মনে করে, ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষের পাশপাশি সরকারি ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের সমর্থকদের হামলার ঘটনা ছিল অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত এবং শিষ্টাচর বহির্ভূত।
দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, পদবাণিজ্য ও মনোনয়ন বাণিজ্য গোটা রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করে তুলেছে। ফলে সারাদেশে উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের সহিংসতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এমএসএফ আরও বলছে, নির্বাচনের ফলকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা ও আধিপত্যের লড়াই হয়েছে মনোনয়ন প্রার্থী ও বঞ্চিতদের মধ্যে, যারা সরকার দলীয় নেতাকর্মী।
ফলে প্রাণনাশের ঘটনা সামাল দিতে কারও কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারদলীয় রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা খুব একটা দেখা যায়নি।
এ ধরনের ঘটনার প্রতিকারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি উল্লেখ করে এমএসএফ বলছে, পাঁচ দফা নির্বাচনে প্রার্থীসহ যেসব মানুষ মারা গেলেন, এর দায় কোনোভাবে নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। একইভাবে দায় এড়াতে পারেন না ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৪০
আপনার মতামত জানানঃ