বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি ভোটে অংশগ্রহণ না করলেও, এমন অভিযোগ এসেছে স্বয়ং নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। সূত্র মতে, যেসব ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা জয়ী হয়েছেন সেখানে অনিয়ম হয়েছে।
এবার তৃণমূলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশের হিড়িক পড়েছে। এখন পর্যন্ত ছয় ধাপে ৩৬৩ জন ইউপি চেয়ারম্যান ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন।
ইসির সংশ্লিষ্টদের মতে, বিনা ভোটে জয় ঠেকাতে না পারায় ভোটাররা যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাকার দাপট ও রাজনৈতিক প্রভাবে অযোগ্যরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় স্হানীয় সরকার কাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে কমিশনের কিছুই করার থাকে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজনের।
আ’লীগের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ষষ্ঠ ধাপ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৬৩ ইউনিয়ন পরিষদে সোয়া ১৭শ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে।
এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৬৩জন, সাধারণ সদস্য (মেম্বার) ৯৫৮জন এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ৩৯৬জন নির্বাচিত হয়েছেন।
এর মধ্যে ৬ষ্ঠধাপে ২১৯টি ইউপির মধ্যে ১২জন চেয়ারম্যান, ১০০জন সাধারণ সদস্য এবং ৩২জন সংরক্ষিত সদস্য বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। আগামী ৩১ জানুয়ারি ওই ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত ৩৬৩জনের মধ্যে ৩৬১ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী।
দ্বিতীয়বারের মতো ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে নির্দলীয়ভাবে ভোট হচ্ছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি এবারের ইউপি ভোট বর্জন করেছে। তবে দলটির নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চমধাপে ৯৬টি উপজেলার ৭১৪টি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৫২ জন প্রার্থী। এছাড়া সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৩২ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ১০৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
গত ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থধাপের ৮৪২ ইউপিতে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। চতুর্থ ধাপে ১২০টি উপজেলার ৮৪২টি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৪৮ জন প্রার্থী। এছাড়া সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১১২ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ১৩৫ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য তৃতীয়ধাপের ১০০০ ইউপির মধ্যে ১০০জন চেয়ারম্যান ভোট ছাড়াই নির্বাচিত। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সদস্য হন ৩৩৭জন এবং সংরক্ষিত সদস্য ১৩২জন।
গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়ধাপের ৮৩৩টি ইউপির মধ্যে মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৮০জন, সংরক্ষিত নারী সাধারণ সদস্য পদে ৭৬ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
গত ২১জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দু’দফায় প্রথমধাপে ৩৬৫টি ইউপির ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ২০ জুন অনুষ্ঠিত ২০৪টি ইউপির মধ্যে ২৮জন চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এছাড়াও ভোট ছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য হিসাবে ৫ জন এবং সাধারণ সদস্য হিসাবে ২৮ জন নির্বাচিত হন।
এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথমধাপের স্থগিত ১৬১ ইউপির মধ্যে ৪৪জন চেয়ারম্যান, সংরক্ষিত সদস্য ৭জন এবং সাধারণ সদস্য ৪৫জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে দলটি
গত ২৬ ডিসেম্বর ছিল ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট। কিন্তু ভোটের আগেই সিন্দুরপুর, রাজাপুর, পূর্ব চন্দ্রপুর, ইয়াকুবপুর ও মাতুভূঞা; এই পাঁচটি ইউনিয়নে জাতীয় পার্টি-জাপা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়ায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
মাতুভূঞা ইউপির জাপার প্রার্থী আব্দুর রহিমের ছেলেকে হত্যার হুমকি দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি।
অন্য ইউপিগুলোতেও এভাবে সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের হুমকিতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। কুমিল্লাতেও সরকারদলীয় এক প্রার্থীকে জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়।
বাগেরহাট, চট্টগ্রামেও একই ঘটনা ঘটে। শরীয়তপুরের চিতলিয়া ইউপিতেও চেয়ারম্যানসহ সব প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হন।
পরবর্তী সময়ে অন্য প্রার্থীরা অভিযোগ করলে নির্বাচন কমিশন চিতলিয়া ইউপির নির্বাচন স্হগিত করে তদন্তের নির্দেশ দেয়। ঐ তদন্তের অনিয়ম করে বিনা ভোটে জয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই পর্যন্ত ভোট সহিংসতায় প্রায় ১০৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভাষ্যানুযায়ী, সহিংসতার বিচারে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনি এই সহিংস ঘটনার কারণে খোদ একজন নির্বাচন কমিশনার চলমান ইউপি নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহিংসতার দায় ভোটার ও প্রার্থীদের ওপর চাপিয়েছেন। আট ধাপে অনুষ্ঠেয় চলমান ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপ-পরবর্তী সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি তিন ধাপে এই সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ১৪টি ইউপির সব কয়টি পদে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মহিলা মেম্বার পদে সবাই ভোট ছাড়াই পাস করে। ওই উপজেলায় কোন ভোট লাগেনি।
একই অবস্থায় কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ৫টি ইউপিতে। সেখানেও সব কয়টি পদে ভোট ছাড়াই পাস করে। এবারের ইউপি ভোটে প্রভাব বিস্তার, সহিংসতা অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ