দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনি শুরু হয়েছে উৎকণ্ঠা। এবারও কি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচন দেখতে পাবে না বাংলাদেশ। দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উপর্যুপরি রুগ্ন চিত্রের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশসহ জাতিসঙ্ঘ এবং বিশ্বের স্বনামধন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো হতাশ। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশে সমসুযোগ সম্বলিত মাঠে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বর্ণিত দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের অবস্থান সরকারের কাছে ব্যক্ত করেছে।
পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর মধ্যে বিশেষত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন অনিয়ম, কারচুপি ও কালিমায় ভরপুর থাকায় এবং উভয় নির্বাচন সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় আগামী সংসদ নির্বাচন উল্লিখিত রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর ব্যক্ত অবস্থানের কারণে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে কঠিন বাধার সম্মুখীন। এখন বড় প্রশ্ন কেমন হবে আসন্ন সংসদ নির্বাচন।
কেমন হতে চলেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন?
ক্ষমতাসীনদের অধীন গঠিত নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষতার ছাপ রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে কখনো সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। অথচ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধানাবলি অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিন সময়কালের মধ্যে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন ২৯ জানুয়ারি ২০২৪-এর অব্যবহিত ৯০ দিন পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে তড়িঘড়ি করে গত ২৯ জানুয়ারি ২০২২ নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়।
এ আইনটিতে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে যে সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটির উল্লেখ রয়েছে তা আগেকার দশম ও একাদশ নির্বাচনের আগে গঠিত সার্চ কমিটির অনুরূপ। তিনটি সার্চ কমিটিতেই একই পদবির চারজন সাংবিধানিক পদধারীর সন্নিবেশন রয়েছে যদিও দ্বিতীয় ও তৃতীয় সার্চ কমিটির প্রথমটিতে দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরটিতে একজন নারীসমেত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তির উল্লেখ রয়েছে।
রাষ্ট্রপতিসহ প্রত্যেক সাংবিধানিক পদধারীর ক্ষমতা সংবিধান ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে এর অতিরিক্ত অপর কোনো আইন দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হলে তার দ্বারা সংবিধান অতিক্রমের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রণীত আইনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত যে দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে তা তিনি কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে সম্পন্ন করতে এককভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন।
সার্চ কমিটিতে উল্লিখিত চারজন সাংবিধানিক পদধারীর সংবিধান নির্দেশিত সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতার অতিরিক্ত রাষ্ট্রপতির মতো অপর কোনো আইন দ্বারা তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত করা হলে তার দ্বারা তাদের নিরপেক্ষতাসহ স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা ও শপথের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয় কি না তা ভাববার অবকাশ রয়েছে।
নব প্রণীত আইনের সার্চ কমিটিসহ ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপিসহ আরো বেশ কিছু দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে দলগুলোর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সার্চ কমিটি কর্তৃক নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় এ দলগুলোর অংশগ্রহণ নেই। এর আগে রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনায়ও এ দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি।
সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস কী বলছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নবম সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর দু’টি সংসদ নির্বাচন যথা দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় একাদিক্রমে ১৩ বছরের অধিক সময় ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছে।
নবম সংসদ নির্বাচন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য মতে, আমাদের দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শতকরা ৮৬ ভাগের অধিক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন অথচ এ নির্বাচনটির এক মাস পর যে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে তাদের দেয়া তথ্য মতে ভোট প্রদানের হার ছিল শতকরা ৪৫ ভাগ।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় নির্বাচনে অধিকসংখ্যক ভোট পড়ে। এক মাসের ব্যবধানে উপরোক্ত দু’টি নির্বাচনে ভোট প্রদানের হারের যে তারতম্য সে বিষয়ে সে সময়কার নির্বাচন কমিশন হতে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত হলেও পাওয়া যায়নি।
তা ছাড়া সে নির্বাচনটিতে নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য মতে, বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪৯ ভাগ পেয়ে ২৩০টি আসন লাভ করে অপর দিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) শতকরা ৩৩.২০ ভাগ ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন লাভ করে। সে নির্বাচনটিতে আওয়াম লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৭.১ এবং আসন সংখ্যা ২৬৩টি।
বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ ব্যবস্থাটি প্রবর্তন-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন দু’টির প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ এবং দ্বিতীয়টিতে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ তাদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবির সাথী জামায়াতে ইসলামীসহ বর্জন করে। এর আগে উভয় দল এ দাবির সমর্থনে পঞ্চম সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এর ফলশ্রুতিতে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের বর্জনের মুখে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
ষষ্ঠ সংসদের মেয়াদকাল ছিল খুবই স্বল্পতম ১২ দিন। এ সময়ের মধ্যে এ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিএনপি দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে এ বিষয়ে আইন পাস করে ওই সংসদের বিলুপ্তি ঘটায়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক আসনে বিজয়ী হওয়ায় দলটি আকস্মিক নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।
পরবর্তী সময়ে দলটি জন আকাঙ্খার বিপরীতে আগেকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী দশম সংসদ নির্বাচন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বর্জনে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনটিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে এর অর্ধেকেরও অধিক আসনের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অপর যে ১৪৭টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এগুলোতে প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের কারণে ভোটার উপস্থিতি নগণ্য হলেও অনুগত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের বাসনা অনুযায়ী সব ধরনের অনিয়ম অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক একপেশে ফলাফল প্রকাশ করে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করে।
সংসদ গঠনবিষয়ক সংবিধানে যে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে তাতে উল্লেখ রয়েছে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভোটে নির্বাচিত ৫০ জন মহিলা সদস্য সর্বমোট ৩৫০ সদস্য সমন্বয়ে সংসদ গঠিত হবে। সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।
দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সংসদ গঠনবিষয়ক সংবিধানের বিদ্যমান বিধানাবলির আলোকে বিবেচনায় নেয়া হলে প্রতীয়মান হয় এ সংসদটি সংবিধানসম্মত পন্থায় গঠিত হয়নি।
দশম সংসদটি সংবিধানসম্মত পন্থায় গঠিত না হলেও এটি তার মেয়াদ পূর্ণের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন দল আগেকার মতো তাদের অধীন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠানের আগে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে, সমসুযোগ সম্বলিত মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
ক্ষমতাসীনদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে জনসমর্থনের দিক থেকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণ করলেও আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগের রাতে সচেতন দেশবাসীকে হতবাক ও বিস্মিত করে ক্ষমতাসীনরা ব্যালট পেপারে জোরপূর্বক সিল মেরে ভোটের বাক্স পূর্ণ করলে নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত দিনের নির্দিষ্ট সময়ের ভোট গ্রহণ প্রয়োজনীয়তা হারায়।
এ নির্বাচনটিতে ফলাফল ঘোষণা পরবর্তী দেখা যায় ক্ষমতাসীনদের আসন সংখ্যা ২৬৬, জাতীয় পার্টি ২২, বিএনপি সাত ও অন্যান্য চার। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত ভোটের যে হার দেখানো হয় তাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের ৭৬.৮৮ ভাগ ও বিএনপি ১২.৩৩ ভাগ প্রাপ্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কর্মরত প্রধান বিচারপতির অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন এ তিনটি নির্বাচন সমসুযোগ সম্বলিত মাঠে অনুষ্ঠিত অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত।
নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান ও আইনের বিধানাবলির আলোকে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবং এ তিনটি নির্বাচনের মধ্যে শেষোক্ত দু’টি নির্বাচন সমসুযোগ সম্বলিত মাঠের অনুপস্থিতিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতদুষ্টতার কালিমায় আবদ্ধ হওয়ায় এ দু’টি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ