হিব্রু ভাষা
আরবি ভাষার মতো হিব্রু ভাষাও আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। মূলত পৃথিবীতে যত সেমেটিক ভাষা আছে সবই আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। হিব্রু একটি সেমেটিক ভাষা। হিব্রু ভাষাকে হিব্রুতে ‘ইভরিত’ বলা হয়। হিব্রু জাতি তথা ইসরাইলিদের কথ্য ভাষা এবং ধর্মশাস্ত্রের ভাষা ছিল হিব্রু। তবে সেই প্রাচীন হিব্রু ভাষা এবং বর্তমানকালের আধুনিক হিব্রু ভাষার মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত হিব্রু ভাষা বেশ কয়েকবার বিবর্তিত হয়েছে।
প্রাচীন হিব্রু ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল প্রাচীন কেনানাইট ভাষাগোষ্ঠী থেকে। আবার কেনানাই ভাষাগোষ্ঠী ছিল উত্তর-পশ্চিম সেমেটিক ভাষা পরিবারের একটি শাখা। পোলিশ ভাষাবিদ আভরাহাম বেন ইউসেফের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৫৫৬ অব্দের মধ্যে ইসরাইল এবং জুদাহ রাজ্যে প্রাচীন হিব্রু ভাষা কথ্য ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়। অবশ্য কিছু স্কলার এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ইসরাইলিদের নির্বাসনের পূর্বে ঐ অঞ্চলের কথ্য ভাষা ছিল প্রাচীন অ্যারামাইক ভাষা। তবে স্কলারগণ মনে করেন, প্রাচীন যে হিব্রু ভাষায় হিব্রু বাইবেল রচিত হয়েছিল তার উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, যখন ইসরাইলিরা ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা নির্বাসিত হয়। এজন্য প্রাচীনকাল থেকে ইহুদিগণ হিব্রুকে পবিত্র ভাষা বা ‘লাশন হাকোদেশ’ বলে থাকে।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বাইবেলের প্রাচীন হিব্রু ভাষা বিবর্তিত হয়ে ‘মিশনাইক হিব্রু’ ভাষার উদ্ভব ঘটে। ঐ সময়ে তালমুদ রচিত হয়। অর্থাৎ, তালমুদের ভাষা ‘মিশনাইক হিব্রু’। তালমুদে হিব্রু বাইবেল থেকে যেসব উদ্বৃতি সরাসরি লিখিত রয়েছে সেগুলো ক্লাসিক্যাল হিব্রুতে লেখা হলেও ব্যাখ্যাগুলো মিশনাইক হিব্রুতে লেখা। তৎকালীন মিশনাইক হিব্রুর কথ্য রূপ এবং লিখিত রূপ কিছুটা ভিন্ন ছিল। কথ্য রূপকে ট্যানাইটিক হিব্রু, প্রাক রাবিনিক হিব্রু বা ‘মিশনাইক হিব্রু ১’ নামে অভিহিত করা হয়। আর লিখিত বা সাহিত্য রূপকে অ্যামোরিক হিব্রু, পরবর্তী রাব্বিনিক হিব্রু বা ‘মিশনাইক হিব্রু ২’ নামে অভিহিত করা হয়। মিশনাইক হিব্রু ভাষা চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্যের ভাষা হিসেবে মধ্যযুগীয় হিব্রু বিদ্যমান ছিল। অনেক ভাষাবিদদের মতে, এ ভাষা ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এটি কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও ইহুদি রাবি ও পণ্ডিতগণ তাদের লেখনীতে এ ভাষা ব্যবহার করতেন। মধ্যযুগীয় হিব্রু ভাষা এবং প্রাচীন হিব্রু ভাষার বৈশিষ্ট্যগত অনেক ভিন্নতা ছিল। প্রাচীন হিব্রু ভাষার ব্যাকরণ, পদক্রম বাক্য কাঠামো প্রভৃতি অ্যারামাইক, গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষা থেকে ধার করা হয়েছিল। তবে মধ্যযুগীয় হিব্রু ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন অভিধানিক রূপ ব্যবহৃত হয়।
একসময় হিব্রু মৃতপ্রায় ভাষায় পরিণত হলেও উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে তা কথ্য ভাষা হিসেবে পুনর্জীবন লাভ করে। আধুনিক হিব্রু ভাষা আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। হিব্রু ভাষার আধুনিক রূপটিকেই আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ইহুদিরা তাদের প্রার্থনায় হিব্রু ভাষার পূর্ববর্তী রূপই ব্যবহার করে থাকেন। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৯ মিলিয়ন (৯০ লাখ) মানুষ হিব্রু ভাষায় কথা বলেন।
হিব্রু লিপি
হিব্রু ভাষার মতো হিব্রু লিপিও প্রাচীনকাল থেকে বহুবার বিবর্তিত হয়েছে। হিব্রু লিপি প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। ইডিশ লিপিবিশারদ সলোমন বির্নবাউমের মতে, প্রাচীন হিব্রু লিপি অর্থাৎ, প্রাচীন ইসরাইল ও জুদাহ রাজ্যের এবং সামারিটানদের দ্বারা ব্যবহৃত প্যালিও-হিব্রু লিপি খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে উদ্ভুত হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইসরাইলিরা ব্যবিলনে নির্বাসনকালে প্যালিও-হিব্রু লিপির ব্যবহার বন্ধ করে এবং বর্গাকৃতির অ্যারামাইক লিপির ব্যবহার শুরু করে। সেকেন্ড টেম্পলের সময়ে এই লিপি বিকশিত হয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ইসরাইলিরা হেরোডিয়ান লিপি দ্বারা প্রভাবিত হয়। অভিবাসনের পরে হিব্রু লিপি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট ভিন্ন ভিন্নভাবে রূপান্তরিত হতে থাকে। কারাইম, জুদিও-আরাবিক, ল্যাডিনো, ইডিশ প্রভৃতি মূল হিব্রু লিপির রূপান্তরিত রূপ। তবে মূল হিব্রু লিপিটি ইহুদি ধর্মীয় গ্রন্থ এবং পণ্ডিতদের লেখনীর মাধ্যমে বেঁচে ছিল। অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকে হিব্রু ভাষার ন্যায় হিব্রু লিপিও পুনর্জীবন লাভ করে।
এক নজরে হিব্রু ভাষার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক
১. হিব্রুকে পবিত্র ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইহুদী সম্প্রদায়ের গোঁড়া ধার্মিকগণ শুধুমাত্র প্রার্থনার সময় এই ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
২. বাইবেল মূলত হিব্রু ভাষায় লেখা হয়েছিল। ২০০০ বছর পর হিব্রু ভাষা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ৯০ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে এই ভাষায় কথা বলে। যদিও কথ্য ভাষা হিসেবে হিব্রু ভাষার সক্রিয়তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবে লিখিত ভাষা হিসেবে হিব্রু’র ব্যবহার কখনো বন্ধ হয়নি।
৩. ইসরাইলের পর, আমেরিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিব্রু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী রয়েছে। আমেরিকার প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ সাবলীলভাবে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে সক্ষম।
৪. হিব্রু লেখার সময় ডান দিক থেকে শুরু করে বাম দিকে লেখা হয়, কিন্তু সংখ্যা লেখার সময় বাম দিক থেকে ডান দিকে লেখা হয়। হিব্রু ভাষার সংখ্যা গুলো একদম ইংরেজি এবং আরবি সংখ্যার মতো।
৫. হিব্রু বর্ণমালায় আবজাদ আছে, আবজাদ একটি লেখার সিস্টেম যেখানে পাঠক যথাযথ স্বরবর্ণ সরবরাহ করতে পারে। হিব্রু ভাষায় স্বরবর্ণ আছে কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই চিহ্নিত করা হয়নি। পাঠককে প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ আলাদা আলাদাভাবে জানতে হয়।
৬. হিব্রু ভাষার নতুন শব্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি অফিসিয়াল কর্তৃপক্ষ আছে নাম- দি অ্যাকাডেমি অব দ্য হিব্রু ল্যাঙ্গুয়েজ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত মানা হয় না। যেমন : চকোলেটিয়ার (যিনি চকোলেট বানায় বা বিক্রি করে) শব্দটির হিব্রু বিকল্প হলো- শোকোলাদাই (shokoladai); কিন্তু এই শব্দটি কেউ ব্যবহার করে না।
৭. খাঁটি হিব্রু শব্দ সমূহ মূলত তিনটি ধাতু শব্দের (কখনো চারটি) ওপর গঠিত হয়। কিন্তু বিগত ১০০ বছরে অসংখ্য নন-হিব্রু শব্দ হিব্রু ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন : হিব্রু ভাষায় গাড়িকে মেকোনিট (mechonit) বলা হয় কিন্তু বর্তমানে অনেকেই গাড়িকে অটো (auto) বলে থাকেন।
৮. বাইবেল শব্দটি গ্রিক থেকে উদ্ভুত হলেও, বাইবেল থেকে অনেক হিব্রু শব্দ ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন : হ্যালেলুইয়া (hallelujah) [ঈশ্বরের প্রশংসা], অ্যামেন (amen) [আমিন], ম্যামন (mammon) [মানি বা অর্থ], স্যাটান (satan) [শয়তান], অ্যাবরাকাড্যাবরা (abracadbra) ইত্যাদি।
৯. হিব্রু এবং আরবি ভাষা খুব কাছাকাছি ধরনের। দুটোই সেমেটিক ভাষা। যদিও তাদের স্ক্রিপ্ট ভিন্ন, তবে ব্যাকরণে সাদৃশ্য রয়েছে। হিব্রু ও আরবি ভাষায় প্রায় কাছাকাছি শব্দের দেখা পাওয়া যায়। যেমন : হিব্রু ‘শালোম’ (shalom) আরবিতে ‘সালাম’; দুটোরই অর্থ- হ্যালো এবং আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
১০. হিব্রু ভাষাভাষীরা অনেক আরবি ভাল অর্থবহ শব্দ সমূহকে গালি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন : sababa- সাবাবা (চমৎকার), mabsut- মাবসুট (সন্তুষ্ট)।
তথ্যসূত্র :
britannica.com
theculturetrip.com
জুদাইজম, মাশরুর ইশরাক
আপনার মতামত জানানঃ