গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
বড় ধরনের আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি থাকা শ্রীলঙ্কা আশঙ্কা করছে, ২০২২ সালে দেউলিয়া হতে পারে দেশটি। রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দ্যা গার্ডিয়ান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় দেউলিয়া হওয়ার এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এই সংকটের জন্য করোনাভাইরাস মহামারি আংশিকভাবে দায়ী। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে থমকে আছে পর্যটন খাত। যা প্রভাব ফেলেছে দেশটির অর্থনীতিতে।
অর্থনৈতিক এই পতনের মুখোমুখি থাকা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা। এই সংকটের জন্য করোনাভাইরাস মহামারি আংশিকভাবে দায়ী। পর্যটন খাতের লোকসানেরও ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উচ্চ ব্যয় ও কর কর্তনের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব কমেছে, চীনের কাছে বড় ঋণ এবং কয়েক দশকের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। দেশি ঋণ ও বিদেশি বন্ডের টাকা শোধ করতে সরকার টাকা ছাপানোর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এসেছে সেখানে।
নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১১.১ শতাংশ ছুঁয়েছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একসময় সচ্ছল মানুষেরাও তাদের পরিবারের ভরণপোষণে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সামর্থ্যও নেই। রাজাপাকসা অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সেনাবাহিনীকে চাল ও চিনির মতো আবশ্যক পণ্য বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এতে জনগণের দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, চাকরি হারানো এবং পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব আয় না থাকা এই সংকটের কারণ। এই খাতের ২ লক্ষাধিক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আসে পর্যটন খাত থেকেই।
পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে যে প্রতি চার জনের একজন পাসপোর্ট অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন। বেশিরভাগ তরুণ ও শিক্ষিত। তারা দেশ ছাড়তে চান। বয়স্কদের কাছে এটি ১৯৭০-এর দশকের মতো। যখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও দেশে উৎপাদন ঘাটতির কারণে রুটি, দুধ ও চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ বিজেওয়ার্ডেনা সতর্ক করে বলছেন, সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা আর্থিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, যখন মানুষের আর্থিক সংকট মোচনের অযোগ্য হয়ে যায় তখন দেশও যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে তা অনিবার্য। উভয় ক্ষেত্রেই কম উৎপাদন এবং বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমদানিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস পায়। তখন তা একটি মানবিক সংকটে পরিণত হবে।
২০২২ সালে দেউলিয়া হতে পারে দেশটি। রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার জন্য বড় বোঝা হলো তাদের বিদেশি ঋণ। বিশেষ করে চীনের কাছে তাদের অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার ৫০০ কোটি ডলার দেনা রয়েছে। গত বছর বেইজিংয়ের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে কলম্বো। আগামী ১২ মাসে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে দেশি ও বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে ৭৩০ কোটি ডলার। এরমধ্যে জানুয়ারিতেই আন্তর্জাতিক বন্ডের জন্য ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার।
অর্থমন্ত্রী রমেশ পাথিরানা জানান, চা বিনিময় করে ইরানের তেলের ঋণ শোধ করার বিষয়ে আশাবাদী সরকার। অতি প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডলারের চা পাঠানো হচ্ছে।
বিরোধীদলীয় এমপি ও অর্থনীতিবিদ হার্শা ডি সিলভা সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে বলেছেন, জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি থাকবে ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশি ঋণ দাঁড়াবে ৪৮০ কোটি ডলার।
তিনি বলেন, পুরো দেশ একেবারে দেউলিয়া হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিত নিভার্দ চাবরাল ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করলেও বিজেওয়ার্ডেনা বলছেন, ঋণ পরিশোধে দেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যেটির ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণতি থাকবে।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কায় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল রেকর্ড ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এসময় তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে সাতশ কোটি ডলার, তা কমতে কমতে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৮০ কোটি ডলারে।
এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত বছরের মার্চ মাসে গাড়ি, ভোজ্যতেল, হলুদসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে লঙ্কান সরকার। স্থানীয় আমদানিকাররা জানিয়েছেন, তারা ডলার জোগাড় করতে না পারায় খাদ্য-ওষুধের মতো অনুমোদিত পণ্যও কিনতে পারছেন না। লঙ্কান জ্বালানিমন্ত্রী উদয় গামনপিলা গাড়িচালকদের কম জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা কেনা যায়।
বাস্তব চিত্র হলো শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বর্তমানে মিলারদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে চালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার কথা ভাবছে শ্রীলঙ্কার সরকার। একই সঙ্গে বাড়তি দামে চাল বিক্রির অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
মুদ্রা সংকট শ্রীলঙ্কাকে এখন মারাত্মক এক সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ডলারের অভাবে দেশটিতে ক্রমেই আমদানি সংকুচিত করে আনা হয়েছে। কলম্বোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন আর আমদানিকারকদের জন্য কোনো ডলার ইস্যু করছে না। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ব্যবহার করা হচ্ছে রেশনিংয়ের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে দেশটিতে একই সময়ে সমান্তরালে ভিন্ন বিনিময় হারের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দেশটিতে এখন ডলারের বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে কালোবাজার।
২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু এরপর থেকেই দেশটির অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
২০২০ সালে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)। বাজেট ঘাটতি বেড়ে জিডিপি ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বড় ধরনের টান পড়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গেছে বিদেশি ঋণ। চরম এই সংকট কাটাতে বিভিন্ন দেশ থেকে ইউএস ডলার ধার করছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছ থেকেও এ ধরনের সহায়তা চায় শ্রীলঙ্কা।
এদিকে এই কঠিন মুহূর্তে শ্রীলংকার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে মোট ২০ কোটি ডলার দিতে চেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ১৯ আগস্ট পাঁচ কোটি ডলার দেওয়া হয়। এরপর পাঠানো হয়েছে আরো ১০ কোটি ডলার।বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংক থেকে রিজার্ভে থাকা অর্থ থেকে শ্রীলঙ্কার জন্যে ছাড় দেয়া হয়।
তবে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া এই সাহায্য সরাসরি অনুদান কিংবা ঋণ নয়। ২০ কোটি ডলারের বদলে শ্রীলঙ্কা সমপরিমাণ রুপি বাংলাদেশকে দেবে। এর সঙ্গে কিছু সুদও পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিকে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ’ নীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১২
আপনার মতামত জানানঃ