‘আমি খোদার কাছে সব বলে দেব’ বলে অসম্ভব অভিমানে মরে গিয়েছিল এক সিরীয় শিশু। আরেক সিরীয় শিশু ভাবছিল, মরে যাওয়াই ভালো। কেননা, বেহেশতে তো না খেয়ে মরতে হবে না।
এই যুদ্ধবাজ বিশ্ব কখনওই শিশুদের জন্য নিরাপদ ছিল না। নিরাপদ ছিল না ২০২১ সালও। এ সময় বিশ্বজুড়ে নতুন-পুরোনো সশস্ত্র সংঘাতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরা। তাদের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে ইয়েমেন, সিরিয়া থেকে ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চল যুদ্ধকবলিত, সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত অনিরাপদ এসব এলাকার শিশুদের চরম মূল্য চোকাতে হয়েছে। প্রাণ দিতে হয়েছে।
মিডিয়া প্রতিদিন দেখাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্য নামক অঞ্চলটির সর্বত্রই মরছে হাজার হাজার শিশু। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে প্রধান বলি হচ্ছে শিশু-কিশোরেরা। সেখানে যুদ্ধে এবং শরণার্থী শিবিরে নিত্য মরছে নাম না জানা সংখ্যাহীন শিশু।
বিপন্ন ও অবরুদ্ধ শিবিরে খাদ্যের অভাবেও প্রাণ দিচ্ছে শিশুরা। বোমা ও গোলার আঘাতে একতরফা নিহত হচ্ছে শিশু এবং নারীরা।
জাতিসংঘের একটি অধিবেশনের আলোচনা থেকে জানা গেছে, দায়েশ, তালেবান ও আল-নুসরা ফ্রন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যত শিশু হত্যা করেছে, তা অকল্পনীয়। অন্যদিকে, ইয়েমেনের যুদ্ধপরিস্থিতিতেও হিংসার বলি হচ্ছে অজস্র শিশু।
এদিকে, সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ উদাহরণ হিসেবে মিয়ানমারের ঘটনা উল্লেখ করেছে।
দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যে গত বছরের শেষ দিকে সেনা অভিযানের পর ৩৫ জনের বেশি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এতে চার শিশুসহ সেভ দ্য চিলড্রেনের দুজন কর্মীও ছিলেন। গত ৩১ ডিসেম্বর ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, বছরের পর বছর ধরে সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলো শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকারের বিষয় উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এতে শিশুদের ভুগতে হচ্ছে। তাদের প্রাণ যাচ্ছে। তাই শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
২০২১ সালের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে শিশু অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘনের ২৬ হাজার ৪২৫টি ঘটনা নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘনের ঘটনা কিছুটা কমেছে। তবে এ সময় শিশুদের অপহরণের ঘটনা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। যৌন সহিংসতা বেড়েছে ১০ শতাংশ।
এর মধ্যে সোমালিয়া, গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো এবং লেক চাদ উপত্যকায় (চাদ, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন ও নাইজার) শিশু অপহরণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। আর শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো, সোমালিয়া ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে বেশি ঘটেছে।
সশস্ত্র সংঘাতের সময় শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। এর ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি।
প্রতিবেদনে ইউনিসেফ জানিয়েছে, গত ১৬ বছরে আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সংঘাতকবলিত ৩০টির বেশি এলাকায় শিশুদের বিরুদ্ধে চরম ভয়াবহতার অন্তত ২ লাখ ৬৬ হাজার ঘটনার কথা নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ।
যুদ্ধকবলিত আফগানিস্তানে ২০০৫ সালের পর থেকে ২৮ হাজার ৫০০-এর বেশি শিশু হতাহত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইউনিসেফ। একক দেশ হিসেবে আফগানিস্তানে শিশু হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে।
এ সময় স্কুল ও হাসপাতালে শিশুদের ওপর হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে এমন হামলা হয়েছে ২২টি।
গত অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ জানায়, ২০১৫ সালের মার্চের পর থেকে ইয়েমেনের সংঘাতে ১০ হাজার শিশু হতাহত হয়েছে। এ ছাড়া বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, কলম্বিয়া, লিবিয়া, মোজাম্বিক, ফিলিপাইনে সশস্ত্র সংঘাতে শিশুরা হতাহতের শিকার হয়েছে।
হেনরিয়েটা ফোর বলেন, সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলো যখন শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, তখনই শিশুদের প্রতি ভয়াবহতা দূর হবে।
তাই ২০২১ সালের শেষে এসব পক্ষের প্রতি আমার আহ্বান, শিশুদের ওপর হামলা বন্ধ করুন। সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করুন।
আরাকান থেকে ইয়েমেন, ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়ায় শিশুহত্যার উৎসব। যত রকমভাবে মানুষের শিশুহত্যা সম্ভব, এরা তার সবকিছুরই শিকার। সিরীয় শিশুরা যখন শরণার্থী নৌকায় পানিতে ডুবে মরছিল, তখন ইয়েমেনের শিশুরা মরছিল সৌদি-মার্কিন কোয়ালিশনের বোমায়।
সিরীয় শিশুরা যখন আইএস-বিদ্রোহী-পশ্চিমা জোট আর সিরীয় সরকারি বাহিনীর ক্রসফায়ারে মরছিল, তখন ইয়েমেনের শিশুরা তিলে তিলে মরছিল দুর্ভিক্ষে।
ক্লাস্টার বোমা, রাসায়নিক বোমা, বিমানের বোমা, কামানের বোমা, ড্রোনের বোমাসহ যত রকম বোমা আবিষ্কার করেছে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, তার সবই প্রয়োগ হয়েছে দেশ দুটিতে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ