বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপে ২০২০ সালে অভিবাসন প্রবাহ অনেকাংশে কমে গেলেও ২০২১ সালে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। চলতি বছর বিভিন্ন দেশে পাঠানো অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে ৬০ হাজারেরও বেশি কর্মী নারী।
প্রায় পাঁচ লাখ কর্মীর মধ্যে ৯৪ শতাংশ কর্মী গেছেন সৌদি আরব ও ওমান। সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ গেছেন সৌদি আরবে। নারী শ্রমিকদের ৬৮ শতাংশ সৌদি আরবে গেছেন।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। রামরু জানিয়েছে, ২০২০ সালে যেখানে কর্মের জন্য ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন, সেখানে চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত গেছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে অভিবাসন প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে বলে মনে করছে রামরু। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি ২০২১: সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন রামরুর চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে, বিশ্ব সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকট, কভিড-১৯ এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমাজের সব ক্ষেত্র এবং প্রায় সব দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রতিফলন ঘটে। ২০২০ সালে, ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ বাংলাদেশি কর্মীরা কাজের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৮১ হাজার ২১৮১ জন কর্মী ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ এর মাঝে অভিবাসিত হন। লকডাউনের কারণে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ২০২০ সালে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত স্থবির হয়ে পড়ে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, মাত্র ৩৬ হাজার ৪১৩ জন বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য অভিবাসন করেছিলেন। ২০২০ সালে সামগ্রিকভাবে অভিবাসনের প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় ৬৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে অভিবাসিত কর্মীর সংখ্যা ছিল সাত লাখ ১৫৯ জন।
২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, মোট ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ বাংলাদেশি কর্মের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগের বছরের (২০২০) তুলনায় ২০২১ সালে অভিবাসন বাড়বে প্রায় দেড়গুণ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ নারী শ্রমিকদের অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে নারী অভিবাসী অনুপাত ছিল মোট অভিবাসীর এক শতাংশেরও কম। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর থেকে নারী অভিবাসনের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত যারা বিদেশে কাজে যোগদান করেন এর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবেই গেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ১৫ জন। ২০২১-এর ফেরত আসা অভিবাসীর সঠিক তথ্য এখনো নেই।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএমইটি ডেটাবেজে যদিও ১০০টিরও বেশি দেশের নাম গন্তব্য দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তবে অভিবাসন মূলত অল্প কিছু দেশেই বেশি। সৌদি আরব, ওমান, সিঙ্গাপুর, কাতার, মালয়েশিয়া, বাহরাইন ইত্যাদি দেশে কর্মীদের সংখ্যা বেশি। কোভিড-১৯ অতিমারী চলাকালীন সৌদি আরব সর্বাধিক সংখ্যক পুরুষ এবং নারী অভিবাসী গ্রহণ করেছে। এর পরের দেশটি হলো ওমান। মোট অভিবাসীর প্রায় ৯৪ শতাংশ (৪১০,১০২) কর্মী এই দুটি দেশে অভিবাসন করেছে। অন্য গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর (২১,৩৩৯ কর্মী, প্রায় ৪ শতাংশ, তৃতীয় বৃহত্তম), সংযুক্ত আরব আমিরাত (১৪,২৭৬ কর্মী, প্রায় ৩ শতাংশ, চতুর্থ বৃহত্তম), জর্ডান (১১,৮৪৫ কর্মী, প্রায় ২ শতাংশ, পঞ্চম বৃহত্তম), কাতার (৯,৭২৮ কর্মী, ২ শতাংশ, ষষ্ঠ বৃহত্তম)। বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য দেশ হলেও ২০২০ এবং ২০২১ সালে এই দেশে খুব কমই অভিবাসন ঘটেছিল। অতিমারী চলাকালীন সৌদি বাজার চালু না থাকলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো।
২০২০ সালে যেখানে কর্মের জন্য ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন, সেখানে চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত গেছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে অভিবাসন প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে
রামরু জানায়, অভিবাসনের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) হয় দেশের ১০টি জেলা থেকে। ২০২১ সালে কুমিল্লা জেলা থেকে সর্বাধিক সংখ্যক আন্তর্জাতিক অভিবাসন হয়েছে (১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হয় আট শতাংশ। এর পরে রয়েছে চাঁদপুর (৪ দশমিক ৫ শতাংশ)। এ ছাড়া এ তালিকায় আরও রয়েছে কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও লক্ষ্মীপুর।
অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এ বছর কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর বড় ঘটনা। সমঝোতা স্মারকে শ্রমিকের অধিকারের যে ভালো ভালো কথা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করলে অভিবাসন আরও বাড়বে ।
তিনি বলেন, করোনাকালে প্রবাসী কর্মীরা নানা সমস্যায় পড়েছের। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যার প্রয়োজনীয় সমাধান করেছে। চলতি বছরের শেষে এসে নতুন কর্মী ও প্রবাসীদের ফিরে যাওয়ার উড়োজাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। আগে যে দেশে যাওয়ার ভাড়া ৪৫ হাজার টাকা ছিল, এখন সেসব দেশের ভাড়া ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটি একটি উদ্বেগজনক দিক।
অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী আরও বলনে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য অভিবাসন করেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৬৮ হাজার ৫৭৯ জন নারী শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। ২০২০ সালে ছিল ২১ হাজার ৯৩৪ জন। সে তুলনায় নারী অভিবাসনের সংখ্যা ২০২১ সালে তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পয়েছে। এই পরিসংখ্যানটিকে একটি নিয়মিত বছরের (২০১৯) চিত্রের সঙ্গে তুলনা করলে নারী অভিবাসন প্রকৃতপক্ষে প্রায় ৪০ শতাংশ (২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬) হ্রাস পাবে ।
বিশ্লেষকরা বলেন, অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি প্রবাসী আয়। ধীরে-ধীরে নারী অভিবাসন বাড়লেও যথাযথ তথ্যের অভাবে বিদেশে গিয়ে নির্যাতন ও ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থার উন্নয়নে নারীদের বিদেশে নেওয়ার আগে কোন কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে প্রকৃত তথ্য দিতে হবে। যে কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘সৌদি আরবে যে নারীরা যান, তারা গৃহকর্মী হিসেবে বাসাবাড়িতে কাজ করেন৷ এই ক্ষেত্রটিই সমস্যার, কারণ, সেখানে যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তা গৃহকর্তার দ্বারাই হন৷ সৌদি আইনে গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেয়া আছে৷ সেখানে বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের প্রটেকশনের কোনো আইন নেই৷’
তারা জানান, ‘জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই৷ পাঠানো হয় সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে৷ স্মারকেও দুর্বলতা আছে৷ যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও এটা আরেকটু শক্ত করা যেতো যে ওখানে গিয়ে কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে যেন ওখানকার আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেটাও করা হয়নি৷ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো নারী যখন এমন অবস্থায় উপনীত হয়, ওই দেশ ছেড়ে আসতে পারলেই সে তখন বেঁচে যান৷
তারা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে সৌদি সমাজের একটা বড় অংশ এখনো মধ্যযুগের ধ্যানধারণা নিয়ে বাস করছে। যা কিছু আমার, তার ওপর আমার অধিকার নিরঙ্কুশ— এই প্রাচীন ধারণা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীর বেতনভুক গৃহকর্মী আর মধ্যযুগের ক্রীতদাসের মধ্যে তফাত বুঝতে অনেকে অক্ষম। সৌদি রাষ্ট্র তাকে সেটা বোঝাতে খুব তৎপর, অবস্থাদৃষ্টে তা–ও মনে হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের লাখ লাখ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে কাজ করছেন, এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরও কর্মী যাতে যেতে পারেন, তা–ও আমাদের দেখতে হবে। তবে যে নারী কর্মী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তার শারীরিক, মানসিক ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠানোর আগে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাকে, পাঠানোর পর তার নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ আরও দৃঢ় করতে হবে। এসব করতে না পারলে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৬
আপনার মতামত জানানঃ