মঙ্গলেও আছে পৃথিবীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো গিরিখাত আর এর মধ্যেই পানির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থার বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণকারী অরবিটারের মাধ্যমে এ পানির সন্ধান পেয়েছেন।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিখাত নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গল গ্রহেও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো গিরিখাত রয়েছে। তাদের ধারণা, এ গিরিখাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি থাকতে পারে। মঙ্গল গ্রহকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত একটি নভোযানের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা এ আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ইএসএ) বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলের ‘ভ্যালিস মেরিনারিস’ নামের অঞ্চলে একটি গিরিখাতে ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি’ শনাক্ত হয়েছে। এই গিরিখাত পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাত যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দীর্ঘ, পাঁচ গুণ বেশি গভীর আর ২০ গুণ চওড়া।
ইএসএ আর রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান রসকসমস যৌথভাবে ২০১৬ সালে ‘এক্সোমারস ট্রেস গ্যাস অরবিটার’ নামের একটি নভোযান মঙ্গল নিয়ে জরিপ করতে পাঠায়। এই নভোযানের ‘ফাইন রেজল্যুশন এপিথার্মাল নিউট্রন ডিটেক্টর (ফ্রেন্ড)’ প্রযুক্তি গিরিখাতটিতে পানি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গত বুধবার ইকারাস সাময়িকীতে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
মঙ্গল গ্রহের বেশির ভাগ পানি মেরু অঞ্চলে এবং তা বরফ আকারে আছে। মঙ্গলের বিষুবরেখার দক্ষিণাংশে ভ্যালিস মেরিনারিস অঞ্চলটি অবস্থিত। সেখানকার তাপমাত্রা সাধারণত পানিকে বরফে পরিণত করার মতো যথেষ্ট ঠাণ্ডা হয় না। ২০১৮ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করেছে নভোযানটি। উল্লেখ্য, এর আগেও মঙ্গলের ধুলার নিচে পানির অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
মঙ্গলের ‘ভ্যালিস মেরিনারিস’ নামের অঞ্চলে একটি গিরিখাতে ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি’ শনাক্ত হয়েছে। এই গিরিখাত পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাত যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দীর্ঘ, পাঁচ গুণ বেশি গভীর আর ২০ গুণ চওড়া।
গবেষণা নিবন্ধের লেখক ও গবেষক ইগর মিত্রফানোভ বলেন, ‘ট্রেস গ্যাস অরবিটার দিয়ে আমরা ধুলাময় স্তরের এক মিটার নিচ পর্যন্ত দেখতে পারি। মঙ্গলের পৃষ্ঠের নিচে কী ঘটছে, তা দেখে জলাধার শনাক্ত করে পারি। আগের যন্ত্রপাতিতে তা করা সম্ভব ছিল না। বিশাল ভ্যালেস মেরিনারিস গিরিখাতে অস্বাভাবিক পরিমাণ হাইড্রোজেনসহ একটি এলাকা শনাক্ত করেছে ফ্রেন্ড নিউট্রন। এ হাইড্রোজেন পানির অণুতে আবদ্ধ রয়েছে। এই অঞ্চলের কাছাকাছি পৃষ্ঠের ৪০ শতাংশ উপাদান জলীয় বলে মনে হয়।’
রাশিয়ার একাডেমি অব সায়েন্সেসের মহাকাশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গবেষণার অন্যতম লেখক আলেক্সি মালাখভ বলেন, ‘আমরা ভ্যালেস মেরিনারিসের একটি কেন্দ্রীয় অংশে পানিতে পরিপূর্ণ দেখতে পেয়েছি, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। এটি অনেকটা পৃথিবীর পারমাফ্রস্ট অঞ্চলের মতো, যেখানে ধ্রুবক নিম্ন তাপমাত্রার কারণে বরফ শুষ্ক মাটির নিচে স্থায়ীভাবে থাকে।’ তিনি বলেন, যে যন্ত্রের সহায়তায় ওই পানির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটির অনন্য পর্যবেক্ষণক্ষমতাই গবেষকদের পানি শনাক্ত করতে সাহায্য করেছে, যা আগে জানা ছিল না।
গবেষণার আরেক লেখক হাকান ভেদেম বলেন, ‘এ আবিষ্কার এক দুর্দান্ত পদক্ষেপ। তবে আমরা কোন ধরনের পানি পেয়েছি, তা জানতে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।’
২০১৮ সালের মে থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পানির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর আগেও একাধিক অরবিটার গ্রহটিতে পানি অনুসন্ধান করেছে। তবে তা গ্রহের উপরিপৃষ্ঠ ছাড়া পর্যবেক্ষণে সক্ষম ছিল না। তবে এই অরবিটার এক মিটার পর্যন্ত নিচে অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম।
২০২২ সালে ইউরোপিয়ান রোসালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন রোভার এবং রুশ প্রতিষ্ঠান কাজাচোক যৌথভাবে মঙ্গলে একটি অভিযান পরিচালনা করবে। ২০২৩ সাল নাগাদ এটি মঙ্গলে অবতরণ করবে। এটি মঙ্গলের মাটি খননে সক্ষম। এর মাধ্যমে গ্রহটির জৈব পদার্থ অনুসন্ধান করবে। এরমধ্য দিয়ে জানা যাবে, মঙ্গল কখনো প্রাণের উপযোগী ছিল কিনা।
পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না কিংবা বসবাস করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই গবেষক-বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন। বিশেষ করে মঙ্গলে গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান পেতে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মূল উপাদান পানির সন্ধান করছিলেন মঙ্গল গ্রহে।
সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ। পৃথিবী থেকে অনেকটা লাল দেখানোর কারণে এর অপর নাম হচ্ছে লাল গ্রহ। পৃথিবীর মতই ভূ-ত্বক রয়েছে এ গ্রহে। এর ভূ-ত্বকে রয়েছে চাঁদের মত অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মত আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ। সৌর জগতের সর্ববৃহৎ পাহাড় এই গ্রহে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্স। সর্ববৃহৎ গভীর গিরিখাতও এই গ্রহে যার নাম ভ্যালিস মেরিনারিস। ১৯৬৫ সালে মেরিনার ৪ মহাকাশযান প্রথমবারের মত মঙ্গল গ্রহ অভিযানে যায়। এই অভিযানের পর থেকে অনেকেই ধারণা করে আসছিলেন যে মঙ্গলে তরল পানির অস্তিত্ব আছে। মঙ্গল থেকে পাওয়া আলো এবং আঁধারের তরঙ্গের মধ্যে পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এই ধারণা করা হয়। বিশেষত মঙ্গলের মেরু অঞ্চল থেকে এ ধরণের পরিবর্তন চোখে পড়ে, যা মহাসাগর বা জলাশয়ের প্রমাণ হিসেবে অনেকেই গ্রহণ করেছিল।
এ বছরের শুরুর দিকে নাসার পাঠানো কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গলের পৃষ্ঠের কাছাকাছি তরল পানি খুঁজে পেয়েছিল। এই আবিষ্কারের পর মঙ্গল গ্রহ যে একেবারেই ঠান্ডা ও শুষ্ক সে ধারণা থেকে সরে আসেন গবেষকেরা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মঙ্গলের পৃষ্ঠে এক ধরনের লবণের অস্তিত্ব আছে যা তরল পানিকে ফ্রিজিং পয়েন্টের নিচে একটি অবস্থায় যেতে সাহায্য করে।
নাসার সোমবারের ঘোষণায় বিশ্ব জুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে। কেননা, মঙ্গলে পানি থাকা মানেই সেখানে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এই লাল গ্রহে ভবিষ্যতে মানুষের বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হলো।
শুধু তাই নয়, অবিশ্বাস্য চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া গেছে মঙ্গলে। রহস্যময়, রক্তিম এ গ্রহে পানির পাশাপাশি আছে অক্সিজেনও। যা প্রাণের জন্য অত্যাবশ্যক। এর মানে এখানে জীবনেরও অস্তিত্ত্ব আছে। তাছাড়া মঙ্গলে অনেক মূল্যবান খনিজ পদার্থেরও সন্ধান পাওয়া গেছে বলে নাসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ফলে মানুষের জন্য সম্ভাব্য বাসস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে একে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ