অদৃশ্য হয়েও বিশ্ববাসীকে এখনো রীতিমতো শাসন করে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস। নারীর ক্ষেত্রে এই ভাইরাস যেন আরো বেশি কঠোর। কোভিড মহামারিতে বিশ্বব্যাপী নারীরা শোষণ ও সহিংসতার স্বীকার হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এখানেই শেষ নয়। কর্মঘণ্টা ও মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়া, চাকরি খোয়ানো, আয় কমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলোতো আছেই। বাল্যবিয়ে, নারীর মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকিও কিন্তু বেড়েছে। করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বে আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারীরা। সব দেশেই করোনার ফলে যে আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছে তাতে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারি চলার সময় দেশের শ্রমবাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কিশোরী ও নারীদের ওপর। এর কারণ, বাংলাদেশের মোট নারী শ্রমশক্তির প্রায় ৯১ দশমিক ৮ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজে নিয়োজিত।
বৃহস্পতিবার ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির (এসডিপি) আয়োজনে এক আলোচনা সভায় এমন তথ্য জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা।
‘অনানুষ্ঠানিক খাতে দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিশোরী ও নারী প্রশিক্ষণার্থীদের ওপর কোভিড-১৯ প্রতিকূলতা মোকাবিলা’ শীর্ষক এই আলোচনাসভা হয় রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে.এম. তরিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ।
ব্র্যাকের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট এশিয়া, পিআরএল এবং মনিটরিং বিভাগের পরিচালক এএফএম শহীদুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে রাখেন অনুষ্ঠানে। পরে কিশোরী ও নারীদের বর্তমান অবস্থা এবং সমাধান হিসেবে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে শিক্ষানবিশ ভিত্তিক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরেন জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি অ্যান্ড প্রিভেনটিং ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির পরিচালক নবনিতা চৌধুরী।
বক্তারা বলেন, করোনা মহামারি চলাকালে দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত প্রায় ৫ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কিশোরী ও নারীদের উপর, যেহেতু বাংলাদেশের মোট নারী শ্রমশক্তির প্রায় ৯১.৮ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে।
গত বছর ব্র্যাকেরই একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীদের নিয়মিত আয় এবং কাজের সুযোগ যথাক্রমে ৬৬ এবং ২৪ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়াও, সারাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং অর্থনৈতিক মন্দা চলার কারণে স্কুল শিক্ষার্থীদের থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার ঝুঁকিও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা সমাজের অন্যান্য বিষয়কেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে.এম. তরিকুল ইসলাম বলেন, মুজিববর্ষে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য সব সংস্থা কাজ করছে। সরকার বেশ কিছু শিল্পক্ষেত্র তৈরি করছে, যেখানে নারীরাও কাজ করবে। এত বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশে ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি নারী কর্মরত। কোভিডের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব ঘটলে এদের বিপর্যয়ের কথাও ভাবতে হবে। কীভাবে তাদের সংকট সামাল দেওয়া যাবে, এ নিয়ে আগাম প্রস্তুতি থাকাও দরকার।
সমাপনী বক্তব্যে ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ বলেন, সময়ের প্রয়োজনে দক্ষতা উন্নয়ন একটি পরিকল্পিত পছন্দ হওয়া উচিত। ঐতিহ্যগত শিক্ষার পরিবর্তে অনেকে দক্ষতা উন্নয়নের শিক্ষাকে বেছে নিতে পারেন।
করোনাভাইরাস মহামারি চলার সময় দেশের শ্রমবাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কিশোরী ও নারীদের ওপর। এর কারণ, বাংলাদেশের মোট নারী শ্রমশক্তির প্রায় ৯১ দশমিক ৮ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজে নিয়োজিত।
এর আগে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে গৃহে কাজ করা ৫৪ শতাংশ নারী এবং পোষাক কারখানায় ১৯ শতাংশ নারী কাজ হারিয়েছেন বলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে ৪২ ভাগ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ এবং অকালে গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সংগৃহীত তথ্যের উপর গবেষণা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে সিপিডি থেকে বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনকে অনিরাপদ মনে করেন। গ্রামের মাত্র ২ শতাংশ শিশু অনলাইনে শিক্ষা প্রোগ্রাম দেখেছে। সরকার এক লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। কিন্তু এই প্রণোদনা পেতে শতকরা ৯১ ভাগ নারী কোনো আবেদনই করেনি। আবার ৫৪ শতাংশ উদ্যোক্তা জানেই না এই প্রণোদনার কথা। মূলত প্রণোদনার জটিলতার কারণে নারী উদ্যোক্তারা এখানে আবেদন করেনি। এই প্রণোদনা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
এর আগে মহিলা পরিষদ আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীরা। এ সময় তারাই বেশি কাজ হারিয়েছে। তাদের ওপর পারিবারিক অপ্রত্যাশিত কাজের চাপ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ঘরে-বাইরে বেড়েছে সহিংসতা।
বক্তারা বলেন, কোভিড-১৯ কারণে সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে নারী-পুরুষের মাঝে থাকা বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। জেন্ডার বাজেটের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে গৃহীত ক্ষেত্রগুলোতে যেমন নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে, সহিংসতা প্রতিরোধে উন্নতি তেমন হয়নি। অর্জন যতটুকু হয়েছে তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের আঞ্চলিক অ্যাডভাইজার ড. নাজনীন আনোয়ার বলেন, ‘করোনার এসময়ে বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। তাদের মধ্যে নানা ধরণের বিষন্নতা তৈরি হচ্ছে। করোনা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এক ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে কাজ করছে’।
অপরপক্ষে একটি মহামারি নারীদের জন্য পৃথিবীকে আরও বৈষম্যমূলক করে তোলে। যদিও এখন রাজনীতিবিদেরা মত দিচ্ছেন যে যেন শুধুই তাৎক্ষণিক সংকটের দিকে মনোযোগ রাখা হয়। কিন্তু মহামারির ইতিহাস বলে, পরবর্তী পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে নারীর জন্য। যেমন, ইবোলা ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইবোলা সংক্রমণ একটু থিতিয়ে আসার পরে পুরুষদের পারিশ্রমিক ঠিকই দ্রুততম সময়ে আগের জায়গায় ফিরে গেলেও নারীদের পারিশ্রমিক মহামারি হওয়ার আগের পর্যায়ে ফিরতে ঢের সময় লেগেছিল এবং এই অবস্থা চলেছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। এর বাইরে বেড়ে গিয়েছিল নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটনাও। সাধারণত লকডাউন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা গেছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নতুন উপাত্ত জানাচ্ছে, করোনা ভাইরাসের মহামারির জেরে চরম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। নারী দরিদ্র হবে অধিক। কাজের সুযোগ, আয়, স্বাস্থ্য, অবৈতনিক শ্রম এবং সহিংসতা— সব দিক দিয়ে নারীর অবস্থান আরও নাজুক ও অসম হবে। তাছাড়া ২০২১সালের মধ্যে বিশ্বে ১ কোটির অধিক মানুষ দারিদ্র হবে আর এই মানুষগুলোর প্রায় অর্ধেকেই থাকবে নারী ও মেয়ে শিশু। চরম দরিদ্র নারীর মোট সংখ্যা হবে ৪ কোটি ৫০লাখ। গৃহস্থালির কর্মসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোতে নারীকর্মী বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোভিড-১৯ কারণে সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে নারী-পুরুষের মাঝে থাকা বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। অর্জন যতটুকু হয়েছে তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে। এমতাবস্থায় তাদের অর্থনীতিমুখী করে স্রোতে ফিরেয়ে আনা জরুরি মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ