বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। পূর্বাঞ্চলের তুলনায় পশ্চিমাঞ্চলের বৈষম্য বেশি। পূর্বাঞ্চলের দারিদ্র্য কমছে বেশি হারে। অন্যদিকে দ্রুত বাড়ছে ভোগও। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে দারিদ্র্য কমছে ধীরে এবং ভোগও কম। অর্থাৎ দেখা যায় পশ্চিমাঞ্চলে ভোগ বৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যের কোঠায়।
বাংলাদেশ গবেষণা সম্মেলনে ‘কনভারজেন্স ইন ইনকাম, পভার্টি অ্যান্ড ইনইকুয়্যালিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ ইউনুস।
প্রতিবেদনে ইউনূস বলেন, জাতীয় পর্যায়ে দেশে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩২ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশে। জাতীয় পর্যায় মাথাপিছু ভোগ মাসিক ২০১০ সালে ছিল ১৪৭১ দশমিক ৫৪ টাকা। সেটি বেড়ে ২০১৬ সালে হয়েছে ১৫০৮ দশমিক ৬৪ টাকা।
কিন্তু আঞ্চলিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলা রয়েছে ২৭টি আর পশ্চিমাঞ্চলের জেলার সংখ্যা ৩৭টি। পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ২০১০ সালে দারিদ্র্য হার ছিল ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এ সময় মাথাপিছু ভোগ ছিল মাসিক ১ হাজার ৬১৩ দশমিক ২২ টাকা। ২০১৬ সালে এসে দারিদ্র্যের হার হয়েছে ২৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ সময় মাথাপিছু ভোগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৯৮ দশমিক ১৯ টাকা।
এদিকে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ সময় মাথাপিছু ভোগ ছিল মাসিক ১ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৬০ টাকা। ২০১৬ সালে এসে দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ সময় মাথাপিছু ভোগ হয়েছে ১ হাজার ৩৭৮ দশমিক ৯৫ টাকা।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে দ্রুত হারে দারিদ্র্য কমছে এবং ভোগ বাড়ছে। তুলনামূলক কম হারে দারিদ্র্য কমছে ও ভোগ বাড়ছে পশ্চিমের জেলাগুলোতে।
ঢাকার যানজটে আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে দেশ
রাজধানী ঢাকার নাগরিকদের সবচেয়ে বড় বিরক্তির কারণ যানজট। একদিকে উন্নয়নের কাজ চলছে, অন্যদিকে রাস্তায় চলছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এই দুয়ে মিলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি বাদ দিয়ে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ঢাকার যানজটে। এ ক্ষতি দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশের সমান।
ঢাকা শহরে যানজটের কারণে বছরে জিডিপির সরাসরি ক্ষতি হচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাথাপিছু আয়ের ক্ষতি হচ্ছে মাইনাস ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সেই সঙ্গে ঢাকার ওভার প্রবৃদ্ধির কারণে ক্ষতি হয় জিডিপির ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) দ্বিতীয় দিনে ‘ঢাকাস ওভার গ্রোথ অ্যান্ড ইস কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহমেদ আহসান। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলন হচ্ছে।
ঢাকা শহরে যানজটের কারণে বছরে জিডিপির সরাসরি ক্ষতি হচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাথাপিছু আয়ের ক্ষতি হচ্ছে মাইনাস ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সেই সঙ্গে ঢাকার ওভার প্রবৃদ্ধির কারণে ক্ষতি হয় জিডিপির ৬ শতাংশ।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে দ্বিতীয় দিনে প্রায় ১৫টির মতো গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়।
পিআরআই পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের যে মানুষ শহরে বাস করে তার অধিকাংশ ঢাকায়। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এর মধ্যে প্রধান শহরগুলোতে বাস করে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার ঢাকায় বাস করে ১১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ। ১০ লাখের মতো মানুষ বাস করে এমন শহর মাত্র ৫টি।
চীনের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩৮ কোটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শহরে বাস করে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। সবচেয়ে বড় শহরে বাস করে ১ দশমিক ৮ শতাংশ, ১০ লাখের মতো মানুষ বাস করে এমন শহর রয়েছে ১০২টি।
ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৩ কোটি। এর মধ্যে শহরে বাস করে ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বড় শহরে বাস করে ২ শতাংশ মানুষ। ১০ লাখের বেশি মানুষের শহর রয়েছে ৫৪টি।
পিআরআই পরিচালক আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের অধিকাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। অন্যান্য শহরে উন্নয়নের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহারেও অন্যান্য শহর পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক। কিন্তু উৎপাদন হয় কম। দারিদ্র্য নিরসনের হার শহরে কম। গ্রামে বেশি। এই হার জাতীয় হারের চেয়ে গ্রামে বেশি। এছাড়া শ্রমিকদের মজুরি হারের প্রবৃদ্ধি শহরে কমছে। আগে যেখানে প্রবৃদ্ধির এই হার ১২ শতাংশ ছিল, এখন সেটি কমে ৮ শতাংশ হয়েছে।
রাতের বেলা বিভিন্ন দেশের উপগ্রহচিত্র দিয়ে উন্নয়নের চরিত্র বোঝা যায় বলে মত দেন আহমাদ আহসান। তিনি দেখান, উত্তর ভিয়েতনামের মানচিত্রজুড়ে আলোর রেখা ছড়িয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ারও বড় একটি অংশজুড়ে আলোর রেখা ছড়িয়ে আছে। রাতের বেলা আলো থাকার অর্থ হলো, সেই নির্দিষ্ট স্থানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলছে। পক্ষান্তরে রাতের বেলা বাংলাদেশের উপগ্রহচিত্রে দেখা যায়, আলোর রেখার ঘনত্ব ঢাকা নগরেই বেশি। চট্টগ্রামে কিছুটা আছে। অথচ বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিহার প্রদেশে আলোর রেখা অনেক বিস্তৃত। পশ্চিমবঙ্গেও তাই। তিনি জানান, বিহারের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে ছোট হলেও তা অনেকটাই বিকেন্দ্রীকৃত।
এসব কারণে ঢাকার জনসংখ্যা সীমা ছাড়িয়েছে। যে যানজট হচ্ছে, তাতে জিডিপির প্রায় আড়াই শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ শতাংশের বেশি আসছে ঢাকা নগর থেকে। গ্রামের মানুষ ঢাকায় এসে আয়রোজগার করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে মাথা তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন মনে করেন, আঞ্চলিক সমতা আনার ক্ষেত্রে অভিবাসনই একমাত্র মাধ্যম নয়। ঢাকা নগরের এই অতিবৃদ্ধি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য সুবিধাজনক হলেও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য শহরের যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, তাতে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে প্রভাব পড়ছে। সে জন্য বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যেতে হবে।
রাজধানীর নান্দনিক বাসযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেন ড. আহম্মদ আহসান, যার মধ্যে রয়েছে— ঢাকার মত আরও কয়েকটি শহর গড়ে তোলা; বাণিজ্য নগর হিসেবে চট্টগ্রামের মত আরও বাণিজ্য নগরী গড়ে তোলা; রাজধানীর বিভিন্ন সেবা এবং বাণিজ্যিক পরিস্থিতিকে আরও উন্নত করা; নগর প্রশাসনকে শক্তিশালী করা; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিকেন্দ্রীকরণ। এছাড়া নগর গবেষণায় আরও মনোযোগ এবং বিনিয়োগের সুপারিশ করেছেন ড. আহম্মদ আহসান। পাশাপাশি অর্থনীতির পরিসংখ্যান অন্যান্য দেশের ন্যায় হালনাগাদ করাও সুপারিশ করেছেন তিনি। ঢাকার এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রায় ১০ বছর আগে একবার করা হয়েছিল।
অপর এক গবেষণায় বিআইডিএসের গবেষক ড. আজরিন করিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসাবে মনে করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয়ের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে আজ মোট ১৫টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। দেশের এবং বিদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন। সম্মেলন শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ