ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ছয় নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। বাংলাদেশে এই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। যিনি স্থানীয়দের মাঝে ঋতু হিজড়া নামে পরিচিত। কালীগঞ্জের নির্বাচন কর্মকর্তা আলমগির হোসেন সোমবার এই খবর নিশ্চিত করেছেন।
রবিবার তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেখানকার নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম সানাকে পরাজিত করেন ঋতু। যা নিয়ে এলাকায় রীতিমত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সইতে হয়েছে অপমান-নির্যাতন
তৃতীয় লিঙ্গের কোন ব্যক্তি হিসাবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া নজরুল ইসলাম ঋতু বলছেন, তাকে নানারকম ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাতে দমে যাননি। জনগণ তাকে ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে।
নজরুল ইসলাম ঋতু নির্বাচনী অভিজ্ঞতা নিয়ে গণমাধ্যমকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ”প্রথম প্রথম আমার ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন যখন ঘনিয়ে এলো, তখন আমার ওপর খুব অত্যাচার শুরু হলো। আমার পোস্টার থাকতো না, আমার লোকজনকে মারধর করা হতো, আমাকে মাঠে নামতে দেয়া হয়নি, অপমান করা হয়েছে।”
তিনি বলেন “তবে আমি বলেছি, আমাকে যতই অপমান করা হোক না কেন, আমার পোস্টার যতই ছিঁড়ুক না কেন, আমার কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু মানুষের মনের ভিতরে যে পোস্টার ঢুকে গেছে, সেটা কিন্তু তারা ছিঁড়ে নিতে পারবে না।”
তিনি এবারই প্রথম কোন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস মহামারির সময় স্থানীয়দের সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার কারণে তিনি বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়দের সমর্থন
রবিবার জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ২৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ছয় নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিন জন। সেখানেই নজরুল ইসলাম ঋতু ‘আনারস’ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান।
ওই ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ১৯ হাজার ছয়শ বলে জানা যায়। এর মধ্যে ভোটে অংশ নিয়েছেন অন্তত ৭৫% ভোটার। প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, নজরুল ইসলাম ঋতু ৯ হাজার ৫৫৭টি ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের নজরুল ইসলাম সানা পেয়েছেন ৪ হাজার ৫২৯টি ভোট। অর্থাৎ বিশাল ব্যবধানেই জিতেছেন ঋতু।
ভোটে জয়ী হয়ে সাংবাদিকদের দেয়া এক সাক্ষাতকারে নজরুল ইসলাম ঋতু বলেন, ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নবাসীর কাছে আমি ঋণী। আমি হিজড়া হলেও মানুষ আমাকে পছন্দ করেছে, আমাকে ভোট দিয়ে পাস করিয়েছে, আমি তাদের মনের আশা পূরণে চেষ্টা করে যাবো।
জানা যায়, নির্বাচনের প্রাক্কালে পোস্টার টাঙিয়ে, মিছিল করে এবং এলাকাবাসীর দ্বারে দ্বারে গিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। বিজয়ী চেয়ারম্যান ঋতু উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সাংবাদিক সূত্র বলছে, নজরুল ইসলাম ঋতুরা মোট সাত ভাইবোন। তার মধ্যে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের, এই বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হওয়ার পর ছোটবেলায় তিনি বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যান।
সামান্য লেখাপড়া করলেও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো হয়নি ঋতুর। ছোটবেলা থেকেই ঢাকার ডেমরা এলাকায় হিজড়াদের এক দলের গুরুমার কাছে বেড়ে ওঠেন। এখন তার বয়স ৪৩ বছর।
এলাকাবাসী জানায়, ঋতু ঢাকাতে থাকলেও পরিবারের টানে প্রায়ই তিনি গ্রামের বাড়িতে আসেন। ১৫ বছর ধরে তিনি ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের অসহায় মানুষকে আর্থিক সহযোগীতা করে আসছেন। এভাবেই এলাকায় তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
ছোটবেলা থেকেই ঢাকার ডেমরা এলাকায় একটি হিজড়া কমিউনিটির সাথে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তবে বাড়ির টানে তিনি প্রায়ই গ্রামে ঘুরতে আসতেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পরে চলতি বছরই তিনি ভোটার এলাকা বদলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
নজরুল ইসলাম ঋতু বলেন, সত্যি কথা বলতে নির্বাচন কী তা বুঝিনি। এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবেসে ভোটে দাঁড় করিয়েছেন। আমার পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগ করলেও আমার কখনো সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করা হয়নি। ভোটে জয়ী হয়ে চেয়ারম্যান হয়েছি, এখন জীবনের বাকি সময় নিজ ইউনিয়নবাসীর সেবা করতে চাই।
এর আগে ১৩ই নভেম্বর খুলনা জেলার মাগুরাঘোনা ইউনিয়ন পরিষদ-৬ থেকে প্রথম ট্রান্স-জেন্ডার সাহিদা বিবি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন সাদিয়া আক্তার পিংকি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ