আফগানিস্তানে তালিবানের পুনরুত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে চীন; এমনটাই মনে করেন আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকরা। যদিও অতীতে আফগান ইস্যুতে চীনের সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখা গেল, আফগানিস্তান বিষয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে চীন। তালিবানের সঙ্গে চীনের সখ্যতাও বেশ পরিলক্ষিত।
এমনকি কাবুল পতনের আগে তালিবানের প্রতিনিধিদের চীন সফর করতে দেখা গেছে। তালিবানদের প্রভাবশালী ব্যক্তি মোল্লা আবদুল গনি বারাদার গত ২৮ জুলাই চীনের তিয়ানজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে দ্বীপক্ষীয় বৈঠক করেন বলে ওই সময় চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এছাড়া চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আফগান ত্যাগের আগে থেকেই তালিবান বেইজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়।
তালিবানদের মুখপাত্র সোহাইল শাহীন ১৯ আগস্ট সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে; একই সঙ্গে দেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়নে চীন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
আফগানিস্তান বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সম্পর্কটি বেশ পুরনো, যা বর্তমানেও বিদ্যমান। তবে চীন কেন হঠাৎ করে দেশটির বিষয় এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে? সে বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণ বলছে, এর নেপথ্য কারণ আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে লিথিয়ামের বিপুল মজুত দেশটির ব্যাপারে চীনকে আগ্রহী করে তুলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বের অপরিহার্য উপাদান লিথিয়াম। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বৈদ্যুতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চাইছে মানুষ। অর্থাৎ তেল-কয়লার বদলে ব্যাটারিচালিত প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে পৃথিবী। আর এই ব্যাটারি তৈরি করতেই প্রয়োজন লিথিয়াম ধাতুটি। বলা হচ্ছে, দুষ্প্রাপ্য এই ধাতু এখন সোনার চেয়েও দামি।
চীন ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরির বিষয়ে জোর দিচ্ছে। এই যানবাহনের অন্যতম প্রধান উপকরণ লিথিয়াম। পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপট আফগানিস্তানের ব্যাপারে বেইজিংকে আগ্রহী করে তুলেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এই আফগানিস্তানের মাটির নিচেই রয়েছে রাশি রাশি ‘গুপ্তধন’, যা অল্প সময়েই ঘুরিয়ে দিতে দেশটির অর্থনীতির চাকা। সূত্র জানায়, আফগানিস্তানের মাটির অভ্যন্তরে ১ লাখ কোটি ডলার মূল্যের ‘গুপ্তধন’ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম খনিজ লিথিয়াম মৌল।
দূষণহীন যান চলাচলের ব্যাটারি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জন্য এ খনিজ আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু প্রকৃতিতে দুর্লভ এবং খনি থেকে সেই মৌলের নিষ্কাশনের পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। তাই এর বহুল ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়াও রাশি রাশি তামা, সোনা, আকরিক লোহাসহ নানা ধরনের বিরল মৌল রয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের মাটির নিচে।
ইকোলজিক্যাল ফিউচার্স গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রড শুনোভার জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের মাটির তলায় কী পরিমাণ ‘গুপ্তধন’ রয়েছে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য জরুরি লিথিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও নিওডিয়াম মৌল আছে সেখান। খনিজ লিথিয়াম সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে এখন বলিভিয়ায়। আফগানিস্তানের ভাণ্ডার তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আর এই খনিজগুলো ব্যবহার করে এক দশকের মধ্যেই এশিয়ার এই অঞ্চলের ধনীতম দেশ হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশই দারিদ্র্যপীড়িত। এই সব দুর্লভ ‘গুপ্তধন’ তোলার সক্ষমতা নেই দেশটির। আর এই খনিজ সম্পদই আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনকে বিশেষ আগ্রহী করে তুলেছে।
যদিও আফগানিস্তানে মজুদ লিথিয়ামের বিষয়টি একেবারেই এড়িয়ে গেছে চীন। চীন বলছে, তালিবানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের মূল লক্ষ্য পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলকে বেইজিংবিরোধী তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের (ইটিআইএম) হাত থেকে রক্ষা করা।
এ বিষয়ে সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অধ্যয়নের অধ্যাপক ঝাং লি বলেন, তালিবানদের ব্যাপারে চীনের প্রাথমিক চিন্তা হলো, আফগানিস্তানে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মধ্যপন্থী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে আফগানিস্তানকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে কেউ জিনজিয়াং বা এ অঞ্চলে সন্ত্রাস ছড়াতে না পারে। এর বাইরে চীনের অন্য কোনো হিসাবনিকাশ থাকলে তা হয়তো ভবিষ্যতে স্পষ্ট হবে। যেই ভবিষ্যৎই এবার সামনে আসলো
গ্লোবাল টাইমসের বরাতে পাকিস্তানি গণমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, অন্তত পাঁচটি চীনা কোম্পানি আফগানিস্তানে লিথিয়ামের খনি অনুসন্ধান করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি এসব কোম্পানির প্রতিনিধিদের একটি দল বিশেষ ভিসা নিয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মাটিতে পা রেখেছেন। তারা দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে লিথিয়ামের খনি অনুসন্ধান করবেন।
তবে, আফগানিস্তানে বর্তমান তালিবান সরকার যখন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তখন এ ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রমকে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণও মানছে চীনা কোম্পানিগুলো।
চীন-আরব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রচার কমিটির পরিচালক ইয়ো মিংগুই বলেছেন, ‘আফগান খনি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই বিশেষজ্ঞ দলটির বিশেষ ভিসা নিশ্চিত হয়েছে।’
মিংগুই জানান, নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিয়েই চীনা বিশেষজ্ঞরা এখন আফগানিস্তানে খনির অনুসন্ধান শুরু করেছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, চীন এবং আফগানিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফলেই চীনা কোম্পানিগুলো তাদের অপারেশন চালানোর অনুমোদন পেয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ