চীন আর যাই হোক, সমাজতান্ত্রিক নয়। বরং পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ফ্রন্টকে ভেঙে নিপীড়িত চীনকে নতুন পথে নিয়ে আসা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিই জন্ম দিয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের। তবে চীনের এই সাম্রাজ্যবাদ মূলত পুঁজিবাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালে এই অবস্থা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। সার্বিয়ান-মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্লাঙ্কো মিলানোভিচ ‘ক্যাপিটালিজম, অ্যালোন’ গ্রন্থে এ বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, চীন মূলত পুঁজিবাদী এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হলেও তার বেলায় মুনাফা নয়, জাতীয় স্বার্থই প্রধান। রাষ্ট্রই এখানে সর্বেসর্বা। পুঁজিবাদ এইখানে ফাঁদ; যার জাল গুটিয়ে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদ।
চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভেটো ক্ষমতা, বৈশ্বিক প্রভাবে অনেক আগে রাশিয়াকে অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমকক্ষতা অর্জন করেছে। তাই মার্কিন মডেলের পুঁজিবাদের সঙ্গে চীনা মডেলের পুঁজিবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব খুব প্রকাশ্য। তবে বর্তমানে মার্কিন মডেলকে চীনের সাথে পাল্লা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ মুক্তবাজারে প্রবেশ করলেও বা উদার গণতন্ত্র বা সংসদীয় গণতন্ত্রের ধার ঘেঁষেও চীন কখনো দাঁড়ায়নি। এই প্রক্রিয়ায় চীন যেমন বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি বিপুলসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। চীন যদি এই প্রক্রিয়া জারি রাখতে পারে, তাহলে চীনা মডেল বৈশ্বিক রূপ নেবে। এজন্য ভুগবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। ইতিমধ্যে চীনা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশ। কূটনীতির পরিভাষায় চীনের এ নীতিকে বলা হচ্ছে ‘ডেবট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’।
ঋণের নামে অর্থনৈতিক আধিপত্য
চীন নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে বিনিয়োগ করছে। চীনা বিনিয়োগ ‘ট্রোজান ঘোড়া’র মতো; যা উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির আড়ালে জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রবেশ করে। এরপর দেশটিকে ‘কখনও পরিশোধযোগ্য নয়’ এমন ঋণের দিকে নিয়ে যায়। যা ‘ঋণের জাল’ হিসেবেও বহুল পরিচিত। ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ করার পর সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ‘ডিফল্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করাই চীনা ঋণের লক্ষ্য। সময়মত পরিশোধ না করায় ঋণ বহুগুণে বেড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, জিবুতির কথা উল্লেখ করা যায়। চীনের কাছে দেশটির ঋণের পারিমাণ এখন তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশেরও বেশি। অপরদিকে চীনের কাছে ইথিওপিয়ার ঋণ তার বার্ষিক আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এবং কিরগিজস্তানের ৪০ শতাংশ বলে ধারণা করা যায়।
চীনের বিরুদ্ধে ঋণের ফাঁদ ফেলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ আছে। ‘সিএফজিডি’ নামে একটি গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণ মতে, আটটি দেশ শিগগিরই চীনের এধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে। দেশগুলো হলো জিবুতি, কিরগিজস্তান, লাওস, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনিগ্রো, পাকিস্তান ও তাজিকিস্তান।
শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে আছে বেশ। একটি উচ্চাভিলাষী বন্দর উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ গ্রহণের সময় বুঝতে পারেনি বেইজিংয়ের কত ভয়ংকর ফাঁদে তারা পা দিচ্ছে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে তারা ২০১৫ সালে বন্দর এবং এর আশেপাশের ১৫ হাজার একর জমি ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিতে বাধ্য হয়।
একই ধরণের ফাঁদে পড়েছে আফ্রিকার দেশ জিবুতি। সেদেশের মূল বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ ভার চীনের কাছে হস্তান্তর করা এখন সময়ের ব্যাপার। দেশটিতে আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর মূল ঘাঁটি অবস্থিত। সঙ্গত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপে জিবুতির ওপর ক্ষুব্ধ। কিরগিজস্তান ও মালদ্বীপ বন্দর, রেল যোগাযোগ ও খনির মতো কৌশলগত সম্পদগুলি চীনের তদারকিতে ন্যস্ত করতে বাধ্য হয়েছে। আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়াও চীনা ঋণ-ফাঁদ কূটনীতিতে সার্বভৌমত্ব ‘হারানোর’ আশঙ্কায় আছে। কেনিয়ারও একই পরিণতি হতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতো নয়, চীনা ঋণের বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ জামানত রাখতে হয়। যেসব সম্পদের দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্য আছে। উদাহরণ হিসেবে এই হাম্বানটোটার কথাই বলা যায়। এটি ভারত মহাসাগরে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাণিজ্যপথের সংযোগকারী বন্দর। গরিব দেশে অবকাঠামো নির্মাণ ও অর্থায়ন করে চীন সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধাজনক ব্যবহার দাবি করে, তার মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তেমনি বন্দরও আছে।
পাশাপাশি নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চীন স্বীয় কোম্পানিগুলোকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো সরাসরি কিনতে উৎসাহিত করে। যেমন চীন ভূমধ্যসাগরে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নগদ অর্থের ঘাটতিতে থাকা গ্রিসের কাছ থেকে পিরায়েয়ুস বন্দর কিনে নিয়েছে, যেটা ইউরোপে বিআরআই প্রকল্পের ‘ড্রাগন হেড’ হিসেবে কাজ করবে।
অন্যদিকে আফ্রিকার উগান্ডা ও জাম্বিয়ায় চীন বিপুল পরিমাণে সম্পদ কিনছে। শুধু আফ্রিকা নয়, ইউরোপের সার্বিয়া, ইতালি, গ্রিস ও এমনকি জার্মানিতেও সম্পদ কিনছে তারা। এই বিনিয়োগ যেকোনো সময় ঋণ-ফাঁদ হতে পারে। বাংলাদেশেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চীনের ঋণ। দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৪ শতাংশ, যার মধ্যে চীনের অংশই প্রায় অর্ধেক; আনুমানিক ৬ শতাংশ। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ঋণ বা অনুদান হিসেবে বাংলাদেশে অর্থায়ন শুরু করে চীন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাকে ঋণ, অনুদান বা অর্থসহায়তা হিসেবে প্রায় ৩২১ কোটি ডলার দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যে ৯১ শতাংশের বেশি এসেছে গত নয় অর্থবছরে।
সামরিক আধিপত্য
সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম স্তম্ভ সামরিক আধিপত্য। আর এই আধিপত্য বাড়াতে আফ্রিকার জিবুতিতে ইতিমধ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে চীন। সেখান থেকে ভারত মহাসাগরে নজরদারি চালাচ্ছে। পরিকল্পনায় আছে আরও বেশ কিছু দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ড্রাইভিং সিটে বসতে হলে, নিজেদের এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ভারতকে ব্যাকফুটেও ঠেলে দিতে হবে চীনের। আর ভারত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত জিবুতিতে চীনের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ইতিমধ্যে উদ্বেগে ফেলেছে ভারতকে। কারণ নয়া দিল্লি মনে করে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলংকাকে দিয়ে ভারতে ঘিরে ফেলতে চীনের যে প্রয়াস এটা তারই একটি অংশ।
গত বছরের মাঝামাঝি মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মিলিটারি অ্যান্ড সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টস ইনভলভিং দ্য পিপলস রিপাবলিক অব চায়না ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, অন্তত ডজনখানেক দেশে নিজেদের সামরিক লজিস্টিক সুবিধা জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। এর মধ্যে তিনটি দেশ বর্তমানে চীনের অন্যতম ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারতের প্রতিবেশী। পেন্টাগনের ওই প্রতিবেদনে ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মিয়ানমার ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কেনিয়া, সিসিলিস, তানজানিয়া, অ্যাঙ্গোলা ও তাজিকিস্তানের নাম রয়েছে।
এসব দেশে নিজেদের সামরিক লজিস্টিকস বেজ স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বেইজিং। এছাড়া চীন নামিবিয়া, ভানুয়াতু ও সলোমন দ্বীপে তাদের সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছে।
‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’
চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’। এই প্রস্তাবনাটি আধুনিক হলেও এর ধারনা প্রাচীন চীনের সিল্ক রোড হতে নেওয়া। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ চীনের হান সম্রাজ্যকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো চিনের “সিল্ক রোড” নামের ঐতিহাসিক বানিজ্য পথ। এই রোড দিয়ে এশিয়া, ইউরোপ, ও আফ্রিকার মধ্যে বানিজ্য সংঘটিত হতো। এই ধারনা থেকেই মূলত চীনের সাথে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে এশিয়া ও ইউরোপের ভূ-খন্ড যুক্ত করার পরিকল্পনার নাম “সিল্করোড ইকোনোমিক বেল্ট” যা ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট এর মধ্যে অন্তভূক্ত।
২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে প্রকল্প কি শুধুই বাণিজ্যিক? নাকি এর অভ্যন্তরে রয়েছে ভূ-রাজনীতির সূক্ষ চক্র? চীনের এই ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’ প্রকল্পকে ‘সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা’ বলে মন্তব্য করেছেন আলবেনিয়ার ইতিহাসবিদ ওলসি জাজেক্সি। চীনের এ উন্নয়ন প্রকল্পকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। ইতিহাসবিদ ওলসি বলেন, ‘অ্যাংলো-আমেরিকানরা ৩০০ বছর যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছে ঠিক সে পথই অনুসরণ করেছে চীন। এ প্রকল্প মূলত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালানোর একটি কৌশল।’
এ প্রকল্পের বিষয়ে ইতিহাসবিদ ওলসি জাজেক্সি বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ মূলত বাণিজ্যের মাধ্যমেই শুরু হয়। তারপর বাণিজ্যের কাঠামোকে সরিয়ে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়। তারপরই নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা দেশের সরকারকে অপসারণ করে সেনাবাহিনী। এভাবেই মূলত সাম্রাজ্যবাদ কাজ করে।’
এ ইতিহাসবিদ বলেন, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ চীনের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প। ব্রিটেন যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছিল সেভাবেই এগোচ্ছে এটি। ব্রিটেনের ওই আগ্রাসনের ফলে গত ২০০-৩০০ বছরে নানা সংঘাত, সহিংসতা লেগেছিল। আর এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন সেই পথেই হাঁটছে।’
তিনি বলেন, ‘শুরুতে ব্রিটেন ভারতে সরাসরি এবং তড়িঘড়ি করে আক্রমণ করেনি। তারা এ অঞ্চলে ব্যবসার কথা বলে এসেছিল। তারা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করে। তাই সাম্রাজ্যবাদ ব্যবসার মাধ্যমেই শুরু হয় এবং সম্প্রসারিত হয়। আর চীন সে পথেই যাচ্ছে।’
চীন-পাকিস্তান-ইরান ভূকৌশলগত জোট
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সাম্রাজ্যবাদের সেনাপতি হল পাকিস্তান। তার সাথে ইরানের পর এবার যুক্ত হচ্ছে তালিবান। ইতিমধ্যেও বাংলাদেশকেও বিভিন্ন খাতে ঋণ ও করোনাকালীন সাহায্য-সহযোগিতার নামে অঘোষিতভাবে নিজের আধিপত্যবাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে চীন। তবে পাকিস্তানের সাথে চীনের দেবর-ভাবী সম্পর্কটা বেশ পুরনো।
গত দশকে ভারত মহাসাগর লক্ষ রেখে চীন পাকিস্তানের বন্দর গোয়াধরকে সামরিক ও বাণিজ্যে কৌশলগত উত্তরণে সমৃদ্ধ করেছে। নির্মাণ করেছে বিভিন্ন প্রকল্প, যা এখনো চলমান। যার বেশির ভাগ বাইরের বিশ্ব জানে না। গোয়াধর হরমুজ প্রণালীর কাছেই বলতে হয়। এছাড়া চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরকে আধুনিকীকায়ন করেছে। বড় জাহাজ অবস্থানের বার্থ বানানো হয়েছে। চীনের বাণিজ্য ও সামরিক কাজকর্ম সহজে সম্পন্ন করা যাবে এই বন্দরের মাধ্যমে। পাকিস্তানও উপকৃত হবে। এখান থেকে শ্রীলঙ্কা গোয়াধর বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। শ্রীলঙ্কায় ইমরান খানের সফরে এ চুক্তিও হয়েছে।
সাগর তীরবর্তী গোয়াদার গভীর সমুদ্র বন্দর এবং সেখান থেকে চীন পর্যন্ত একটি জ্বালানি পাইপলাইন বসানোসহ পাকিস্তানে ডজন ডজন অবকাঠামো প্রকল্পে চীন ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ বিলিয়ন (৬,০০০ কোটি) ডলার ব্যয় করবে। সেই সাথে, চীন ইরানের সাথে একটি চুক্তি করেছে যার আওতায় তারা বন্দর আব্বাসের আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণসহ সেদেশের একগাদা অবকাঠামো এবং জ্বালানি প্রকল্পে আগামী ২৫ বছরে ৪০০ বিলিয়ন (৪০,০০০ কোটি) ডলার বিনিয়োগ করবে। এই চুক্তিতে বাণিজ্যের সাথে সামরিক বিষয়ও সংযুক্ত। এভাবেই চীন দুই আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তান ও ইরানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার জোট গড়েছে।
পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর এক মুসলিম দেশ। সে জন্য মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তানের আলাদা কদর রয়েছে। পাকিস্তান কয়েক বছরে ফাইটার জেট প্রকল্পে বিমান তৈরি করে অস্ত্রবিক্রির ফোরামে প্রবেশ করেছে, যা ভারতের নেই। ইউরোপে খাদ্য রফতানিতে ভারত-পাকিস্তান সমান। অর্থনীতি ও ডিফেন্স খাতে পাকস্তান আঞ্চলিক হাব। চীন ইরানের মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে পাকিস্তান ত্রিশক্তির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। নতুনভাবে তেল-গ্যাস প্রাপ্তি ও চীনের রোডবেল্ট ইনিসিয়েটিভ পাকিস্তানি পণ্যের বিরাট সম্ভাবনাও খুলে দিয়েছে।
তালিবানকে সমর্থন
পাকিস্তানের মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই চীন তালিবানের সাথে তলে তলে যোগাযোগ রক্ষা করছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এই ধারণাকে সত্য প্রমাণ করল তালিবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার চীন সফর। যদিও চীন মুখে বলছে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে তারা পাকিস্তানের সাথে যৌথভাবে কাজ করবে। তাদের মতে, আফগানিস্তানে যেকোন অস্থিতিশীলতার প্রভাব প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানে সরাসরি গিয়ে পড়বে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
তবে অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানকে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বি আর আই) প্রকল্পে যুক্ত করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে চীন। সেই সাথে, আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের ওপর চীনের লোভ রয়েছে বলে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন। তবে মধ্য এশিয়ায় ঢোকার জন্য বা তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানকে চীনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। পাকিস্তান এবং ইরানের সাথে চুক্তি করে সেই লক্ষ্য তারা ইতিমধ্যে হাসিল করছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে চীন আফগানিস্তানে জাতীয় আপোষ-মীমাংসার সমর্থন করলেও, তারা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসক হিসাবে মূলত তালেবানকে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। শুধু চীন নয় বাকি বিশ্বও এক রকম নিশ্চিত যে তালেবানই আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিচ্ছে বা অন্তত ক্ষমতার প্রধান শরীক হতে চলেছে।
এদিকে, অশান্ত আফগানিস্তানের জন্য পাকিস্তান অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। চীন ও ইরানের নিরাপত্তাও আফগান ইস্যুর সাথে জড়িত। যদিও আফগান সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান ও ইরান একই অবস্থানে ছিল না। পাকিস্তান ছিল তালেবানদের পক্ষে, ইরান ছিল উত্তর অ্যালায়েন্সের পক্ষে। চীন আফগানিস্তানের সাথে জড়িত, কেননা চীন বেল্ট ও রোড প্রকল্পে আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করতে চায়। আফগানিস্তানে শান্তি ও রাজনৈতিক স্থায়িত্ব না এলে প্রকল্পটি কার্যকরভাবে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। চীন মধ্য-এশিয়ায়ও বিআরআই প্রকল্প কার্যকর করতে চায়। এসব স্থানে অশান্তি অর্থনৈতিক দুর্গতি থাকলে চীনের এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখবে না। তাই আফগানিস্তানসহ পুরো মধ্য এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে চীন আগ্রহী।
অন্যদিকে তালেবানও বুঝতে পারছে যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং আফগানিস্তানে পুনর্গঠনে তাদের কাড়ি কাড়ি টাকা দরকার হবে এবং সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র চীনের। ফলে এখন চীনের আস্থা অর্জন ছাড়া তাদের সামনে কোন বিকল্পও নেই। তাই আফগানিস্তানের সাথে চীনের এই মিত্রতা বজায় থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার চীনের নোঙরকে আরও দৃঢ় হবে।
আপনার মতামত জানানঃ