ভূ-ত্বকে সঞ্চিত শক্তির তরঙ্গ আকারে বহিঃপ্রকাশে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। হঠাৎ ওই নির্গত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ভূমিকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে। ভূ-গর্ভস্থ রকের সঙ্গে বিদ্যমান ফল্টের ধাক্কায়ও ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। যখন দুটি প্লেট একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান করে, তখন কিছুটা আটকে থাকে। যখন প্লেটে বিদ্যমান শিলাগুলো ভেঙে যায়, তখনই মাটিতে কম্পন দেখা দেয়।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আজ শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ছয় দশমিক এক। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) এ তথ্য জানিয়েছে।
তাদের দেওয়া তথ্য মতে, আজকের ৬ দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন স্থান। মিয়ানমারের চীন রাজ্যের হাখা শহরের ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এর উৎপত্তি।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী এই ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ভুটান ও চীনে। ভূমিকম্পটি সৃষ্টি হয় ভূপৃষ্ঠের ৪২ কিলোমিটার গভীরে।
ঢাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের দুটি ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। এতে বহুতল ভবনগুলো বেশ জোরালোভাবে দুলেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একজন গবেষকের মতে, আজকের ভূমিকম্প অদূর ভবিষ্যতে যে বড় আকারের ভূমিকম্প ঘটতে চলেছে তারই সূচক।
চবির ভূগোল ও পরিবেশ অধ্যয়নের শিক্ষক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর গবেষক বিশ্বজিৎ নাথ বলেন, ‘সমগ্র হিমায়ন রেঞ্জে আজ ২ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬ মেগাওয়াট পর্যন্ত ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে’।
আর এসব ঘটেছে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে। এটি একটি ‘ইন্ট্রাপ্লেট মুভমেন্ট’ যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সমস্ত থ্রাস্ট ফল্ট লাইনগুলো সক্রিয় রয়েছে।
তিনি বলেন, খুব শীঘ্রই যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে পারে এটি তার এক বিরাট সূচক।
বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন, প্রচুর বৃষ্টিপাত, কার্বনডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি, বাঁধ নির্মাণ, বনায়ন ধ্বংস, জিওথার্মাল শক্তির স্থানান্তর ও জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গ্রিন হাউজ গ্যাস ক্রমান্বয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে ওই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা পৃথিবীতে বিদ্যমান বরফ গলিয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়াতে সাহায্য করছে। ওই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সমুদ্রের পানি, ভূ-গর্ভস্থ ফল্টে পানির পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, যদি ভূ-গর্ভস্থ ফল্টে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়, তাহলে ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আজকের ভূমিকম্প অদূর ভবিষ্যতে যে বড় আকারের ভূমিকম্প ঘটতে চলেছে তারই সূচক।
অন্যদিকে বনায়ন ধ্বংসে ভূমিধসের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। ওই ভূমিধসে ভূগর্ভস্থ মাটিতে বিদ্যমান আন্তঃশক্তি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে টেকটোনিক প্লেটের গতি বেড়ে হঠাৎ ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। আবার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতও ভূমিকম্প বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। আগ্নেয়গিরিতে বিদ্যমান ‘রিং অফ ফায়ার’ ভূমিকম্পের প্রতি সংবেদনশীল। ওই রিং অফ ফায়ারে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ ভূমিকম্প দেখা যায়।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত আবাসন ও শহরায়ন গড়ে উঠেছে। ওই পাহাড় ধ্বংসে ভূমিধস বেড়ে যায়। ফলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা যায়। ফ্লোরিডায় ইউনিভার্সিটি অফ মিয়ামিতে গবেষণায় দেখা যায়, বৃষ্টিপাত ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, টানা বৃষ্টিপাতে ২০১০ সালের দিকে হাইতিতে রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনে ছিল। অন্যদিকে ওই বৃষ্টিপাতে, ২০০৯ সালের দিকে তাইওয়ানে প্রায় ছয় দশমিক চার মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। মোটা দাগে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টিপাত, সাইক্লোন ও ঝড়ের প্যাটার্ন অনাকাক্সিক্ষত হারে পরিবর্তিত হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের প্রাদুর্ভাব বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই লণ্ডভণ্ড হতে পারে রাজধানী ঢাকা। ধসে পড়বে নগরীর প্রায় ৭২ হাজার ভবন। বিশেষজ্ঞ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকায় অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও গ্যাস-বিদ্যুতের বিপজ্জনক সংযোগের কারণেই জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঢাকার ৭০ শতাংশ ভবন ভূমিকম্পসহনীয় নয়। তা ছাড়া এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আমাদের নেই। ফলে বড় কোনো ভূমিকম্পে রাজধানী পরিণত হবে কংক্রিটের স্তূপে। তাই ঝুঁকির তালিকায় থাকা জরুরি সেবার ভবনগুলোকে বিল্ডিং কোড মেনে নিরাপদ করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই ১২টি ভূমিকম্প ফাটল আছে। প্রতি ১০০ বছর পর পর ফাটল থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। সাধারণত বড় মাত্রার ভূকম্পন হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে নয়, তবু ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও বিন্যাসের স্বকীয়তা বাংলাদেশকে ভূমিকম্প মণ্ডলের আশপাশেই ফেলেছে। ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ফলে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে আছি আমরা।
রাজউক ও বুয়েটের গবেষণায় দেখা গেছে, রাজউকের এলাকায় থাকা ১২ লাখ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা প্রায় চার লাখ ভবনের ৭০ শতাংশই ভূমিকম্পসহনীয় নয়। অর্থাৎ বড় মাত্রায় ভূমিকম্প হলে এগুলো বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মাঝারি ভূমিকম্পও এদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এদেশের ভবনগুলো দুর্বল এবং ভূমিকম্প সহনশীল নয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করতে প্রথম কাজই হবে ভূমিকম্পে ঝুঁকি কেন তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। বিশেষ করে শহর এলাকার কোন জায়গার মাটি দুর্বল, কোন জায়গার শক্তিশালী তা বিবেচনায় নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু প্রাইভেট যে বাড়িঘর হয়ে গেছে সেগুলো তো পরিবর্বতন করা এত সহজ নয়। ব্যক্তির ওপর এটা নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে প্রথম কাজ হলো নগরবাসীকে সচেতন করা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইদানীংকালে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনও বৃষ্টি হচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৭
আপনার মতামত জানানঃ