ভারতীয় উপমহাদেশে আজ যারা মুসলমান, তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে গবেষণা ও আলোচনার ক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরেই ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রশ্নটি কেবল ধর্মীয় নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজ এবং রাজনীতির সাথেও গভীরভাবে জড়িত। এই অঞ্চলের শতকোটি মুসলমানের মধ্যে কতোজনের পূর্বপুরুষ আরব, তুর্কি কিংবা পারস্য থেকে এসেছিলেন আর কতোজন স্থানীয় ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের ফিরতে হবে হাজার বছরের ইতিহাসে।
ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আসে সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ১৫) মুসলিম সেনারা থাট্টা এবং ডাইবুল অঞ্চলে অভিযান চালায়, কিন্তু সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের নির্দেশে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু ও মুলতান দখল করেন। এই ঘটনা উপমহাদেশে ইসলামের আনুষ্ঠানিক আগমনের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও ধর্মান্তর তখন ব্যাপক আকারে ঘটেনি।
এখানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা উল্লেখ করা দরকার। খ্রিষ্টীয় ১২০০ সালের দিকে, আফগান সেনাপতি মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বঙ্গ ও বিহার অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি মুসলিম শাসক মুহাম্মদ গোরির অধীনে ভারতের পূর্বাঞ্চলে সামরিক দখল বাড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যা একসময়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, খলজির আক্রমণের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, খলজি তার সেনাবাহিনী নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ভিক্ষু ও পণ্ডিতদের হত্যা করেন। হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি ও জ্ঞানভাণ্ডার পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই ঘটনাটি ছিল শুধুমাত্র একটি সামরিক অভিযান নয়; বরং এটি ছিল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকেও অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক।
এই আক্রমণের ফলে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রাণ হারান বা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শিক্ষা ও গবেষণার এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্ম অনুগামীদের অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হন, অথবা ধর্ম পরিবর্তন করেন অস্ত্রের ভয়ে।
যদিও ধর্মান্তরের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবুও এ ধরণের সহিংসতার ফলে বহু মানুষ ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছিল বলে ঐতিহাসিক অনুমান। ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের বলপ্রয়োগকৃত ধর্মান্তরের ঘটনাগুলি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
উল্লেখ্য, প্রথম দিকে ইসলাম মূলত রাজনৈতিক ও সামরিক শাসনের মাধ্যমে উপমহাদেশে প্রবেশ করে, তবে তার ব্যাপকতা ও গভীরতা আসে পরে—বিশেষ করে সুফি সাধক ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।
রিচার্ড ইটন (Richard M. Eaton), একজন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, তার বই “The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760″–এ দেখিয়েছেন যে ইসলাম শুধুমাত্র তরবারির দ্বারা ছড়ায়নি, বরং সুফি সাধকদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অনেক অঞ্চলে প্রসার লাভ করেছে।
তবে এটি বলা যায় না যে উপমহাদেশের সব মুসলমানের পূর্বপুরুষই আরব বা পারস্য থেকে আগত। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের পূর্বপুরুষ মূলত স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন, যারা বিভিন্ন কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই ধর্মান্তরের কারণগুলো ছিল জটিল ও বহুমাত্রিক।
আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “আইন-ই-আকবরি”–তে উল্লেখ করেন যে মুঘল আমলে মুসলিম জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল মূলত ধর্মান্তরের মাধ্যমে, তবে সেটা স্বেচ্ছায় এবং ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে। অনেক সময় সামাজিক বৈষম্য, জাতপাত প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, এবং সুফি সাধকদের মানবিকতা ও ন্যায়বোধে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলার প্রেক্ষাপটে দেখা যায়—চন্দ্র, পাল এবং সেন রাজবংশের সময় হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক চর্চা ছিল। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে ইসলামের প্রসার শুরু হয় এবং এটি রাজনীতি ও সমাজের গভীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
ড. সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায়, তাঁর “Origin and Development of the Bengali Language” গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, বাংলার অনেক স্থানীয় জনগণ—বিশেষত নিম্নবর্ণের মানুষ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সামাজিক নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
১২ শতকের শেষভাগে ও ১৩ শতকের শুরুতে সুফি সাধকেরা উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম প্রচারে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। বাংলায় শাহ জালাল (১৩০৩), শাহ মখদুম রূপোশ, খানজাহান আলী, শেখ বাদশা, শেখ ফরিদসহ বহু সুফি সাধকের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, যাঁরা ধর্মের চেয়ে মানবিকতা, সমতা, দানশীলতা ও সামাজিক ন্যায়ের বার্তা দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করেন।
রিচার্ড এম. ইটন, তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760-এ বলেন, “ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এবং প্রধানত কৃষি সম্প্রসারণ, ভূমির উন্নয়ন, ও সামাজিক সাম্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল। ইসলাম বাংলার পূর্বাঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কারণ সেখানে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব ছিল দুর্বল।”
তাঁর গবেষণায় বলা হয়েছে, ১২৫০ থেকে ১৫৫০ সালের মধ্যে নতুন বসতি গড়ে ওঠে বিশেষ করে নদী ও বিল অধ্যুষিত এলাকায়, যেখানে মুসলমান সুফিরা ভূমি উন্নয়নের কাজ করেন এবং সেইসাথে ধর্ম প্রচারও করেন।
ধর্মান্তরের কারণ
ধর্মান্তরের পেছনে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণকে দায়ী করা যায়:
জাতপাত ও ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার: বহু নিম্নবর্ণের মানুষ, যাঁরা হিন্দু সমাজে বৈষম্যের শিকার ছিলেন, তাঁরা ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা অর্জনের চেষ্টা করেন।
সুফি মানবতাবাদ: সুফিরা সরল জীবন যাপন, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা দিয়েছেন। তারা সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গেছেন, ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ ও বসতি স্থাপন: নতুন জমিতে যারা বসতি গড়েছেন, তাদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল বেশি। অনেক সময় জমি ও নিরাপত্তার বিনিময়ে ধর্মান্তর ঘটত।
রাজনৈতিক সুবিধা: ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে কিছু প্রশাসনিক ও কর সুবিধা পাওয়া যেত। অনেক পরিবার এই সুবিধার কারণে ধর্মান্তরিত হয়।
বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্ক: মুসলিম পরিবারের সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে অনেক নারী পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।
ড. আমির আলি, ড. মোহাম্মদ হাবিব, ড. নুরুল হকসহ আরও অনেক গবেষক এ বিষয়ে একমত যে উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমান পূর্বে হিন্দু, বৌদ্ধ বা স্থানীয় ধর্মীয় পরিচয়ের অধিকারী ছিলেন। ধর্মান্তর শান্তিপূর্ণ, ধীরে ধীরে ও সাংস্কৃতিক অভিযোজনের মধ্য দিয়ে হয়েছে।
ব্রিটিশ যুগে করা আদমশুমারি থেকেও এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। ১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলার পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৫৫%-এর উপরে, যা আরও বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে এই সংখ্যা ৭০%-এর কাছাকাছি পৌঁছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে আজ যারা মুসলমান, তাদের পূর্বপুরুষদের অনেকেই মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা স্থানীয় ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ইসলাম এখানে এসেছে যুদ্ধের মাধ্যমে, কিন্তু স্থায়ী হয়েছে সুফি মানবতাবাদ, সামাজিক সাম্য ও সাংস্কৃতিক অভিযোজনের মাধ্যমে। এই ধর্মান্তর ছিল এক জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের অংশ। ইতিহাসবিদদের গবেষণার ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে বলা যায়—ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের শিকড় মূলত এই মাটিতেই প্রোথিত। তাদের ইতিহাস মানেই এই উপমহাদেশের ইতিহাস।
আপনার মতামত জানানঃ