আজকের ভারতীয় উপমহাদেশে গরুকে একটি পবিত্র প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। ভারতীয় রাজনীতিতেও গরুর মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ‘গোরক্ষা’, ‘গোহত্যা’ ইত্যাদি শব্দগুলো এক অতি সংবেদনশীল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস কি বলে? গরুকে কি আদিকাল থেকেই হিন্দুরা পূজা করতো? কখন শুরু হলো গরুকে ‘মাতা’ হিসেবে দেখার সংস্কৃতি? গরুর মাংস খাওয়ার রীতি কি ছিল? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর আগের প্রাচীন ভারতে।
প্রাচীন বৈদিক যুগে গরুর ভূমিকা
রিগ্বেদ, যা প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের একটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, সেখানে গরুর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে ভূমিকা কেবল কৃষিকাজের সহায়ক প্রাণী হিসেবে নয়—ধর্মীয় আচারে বলি ও খাদ্য হিসেবে গরু ব্যবহারের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়।
রিগ্বেদের একটি স্তোত্রে (Rigveda 10.86.14) বলা হয়েছে, “যজ্ঞে গাভী ও ষাঁড় উৎসর্গ করা হয়।“ এছাড়া “ঋষি অত্রি তাঁর পিতার জন্য একশ গরু জবাই করেন” — এমন বিবরণও দেখা যায়।
রিগ্বেদে “গোহত্যা” শব্দের ব্যবহার থাকলেও সেখানে গরু হত্যা মানে ‘গরুকে হত্যা’ নয়, বরং ‘গরু হত্যা করে উত্সর্গ করা’ বোঝানো হয়েছে। বহু স্কলার যেমন রোমিলা থাপার, ডি এন ঝা (D.N. Jha), ও প্যাট্রিক অলিভেল প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এসব রেফারেন্স বিশ্লেষণ করে বলেন, গরু একদিকে মূল্যবান পণ্য হলেও অন্যদিকে ভোজ্য প্রাণীও ছিল।
ধর্মীয় আচারে গরুর মাংস
আচার্য অপস্তম্ব (Apastamba Dharmasutra), গৌতম ধর্মসূত্র ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থে গরুর মাংস খাওয়ার বিধান ছিল নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান ও অতিথি আপ্যায়নের সময়। মনুস্মৃতি (যা প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দে রচিত) স্পষ্ট করে বলেন, “যদি ব্রাহ্মণ অতিথি এসে থাকেন, তবে তাকে আনন্দ দিতে গরুর মাংস রান্না করা পুণ্যের কাজ।” (Manusmriti 3.116-120)
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জন্য নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মাংস খাওয়া অনুমোদিত ছিল, বিশেষ করে যজ্ঞ, শ্রাদ্ধ ও অতিথি আপ্যায়নে। অথচ আজ সেই সংস্কৃতিই পুরোপুরি উল্টো: গরুর মাংস খেলে সামাজিকভাবে বহিষ্কৃত হতে হয়।
বৌদ্ধ ও জৈন প্রভাব: অহিংসার উত্থান
খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে যখন মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন, তারা উভয়েই ধর্মে অহিংসাকে সর্বোচ্চ স্থান দেন। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাবে পশু বলির বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর ফলে ভারতীয় সমাজে ধীরে ধীরে গরুর মাংস খাওয়ার রীতি ক্ষীণ হতে থাকে।
তবে এই পরিবর্তনও রাতারাতি হয়নি। সম্রাট অশোকের (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮–২৩২) শিলালিপিতে দেখা যায়, তিনি গরু ও অন্যান্য প্রাণী হত্যার পরিমাণ কমিয়েছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেননি। [Sources: Asokan Edicts, Rock Edict I]
অর্থাৎ, বৌদ্ধ যুগে পশু হত্যা কমে এলেও গরুর মাংস খাওয়ার রীতি এখনও সমাজে ছিল। কিন্তু তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে আসতে থাকে।
ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণ এবং গরুর পবিত্রীকরণ
গুপ্ত যুগ (৩২০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং তারপরে শংকরাচার্যের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সময়, হিন্দু ধর্ম এক সুসংহত রূপ পেতে থাকে। এ সময় গরুকে কৃষির সহায়ক ও মায়েরূপে দেখা শুরু হয়। গরুর দুধ, গোবর, গোমূত্র ইত্যাদিকে পবিত্র উপাদান হিসেবে দেখা শুরু হয়।
শংকরাচার্য, মাধবাচার্য ও রামানুজ প্রভৃতি ধর্মতাত্ত্বিকেরা গরুকে ‘গোমাতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া শুধু নিষিদ্ধ নয়, বরং পাপের সমান বিবেচিত হতে থাকে। [Source: Romila Thapar, The Past Before Us; Louis Dumont, Homo Hierarchicus]
মধ্যযুগ: রাজনৈতিক রূপান্তর ও গোহত্যা ইস্যু
মধ্যযুগে মুসলিম শাসনের আবির্ভাবের পর গোহত্যা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। অনেক সময় হিন্দু-মুসলিম বিরোধে গরুর মাংসকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হত। যদিও মুঘল শাসক আকবর গরু হত্যায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
শিবাজি, যিনি মারাঠা হিন্দু রাজা ছিলেন, তিনিও গরু হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এভাবে গরুর পবিত্রতা কেবল ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক মর্যাদাও পেতে শুরু করে।
ব্রিটিশ শাসনকাল: গোরক্ষা আন্দোলনের উত্থান
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের শাসনকালে হিন্দুদের মধ্যে গোরক্ষা আন্দোলন শুরু হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন আর্য সমাজের স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। তাঁর ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ গ্রন্থে গরুকে পূজা করার প্রচলনকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রথম গোহত্যা বিরোধী দাঙ্গা ঘটে। এটি ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও ব্রিটিশ আইন ব্যবস্থার দ্বন্দ্বের সূচক। এই সময় থেকেই গরুর মাংস একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।
আধুনিক হিন্দুধর্মে গরুর স্থান
স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে গরু হত্যার ওপর কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, অধিকাংশ রাজ্যে গরুর মাংস খাওয়া বা গরু জবাই নিষিদ্ধ। বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন গোরক্ষাকে নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে।
বর্তমানে ভারতে গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে বহুবার সহিংসতা হয়েছে। অনেক মুসলিম বা দলিত ব্যক্তি গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। অথচ এই একই ভূখণ্ডে একসময় গরুর মাংস ছিল উৎসব ও ধর্মাচারের অংশ।
ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিচার করলে, ‘গোমাতা’ ধারণা নতুন
গরুকে পূজা করার ধারণাটি কোনো চিরন্তন ধর্মীয় বিধান নয়, বরং এটি একটি সময়ভিত্তিক সামাজিক রূপান্তরের ফল। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গরু একটি দরকারি প্রাণী হলেও তার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের অহিংসা নীতির প্রভাবে, এবং পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের মাধ্যমে গরু এক ‘পবিত্র মাতা’ রূপে রূপান্তরিত হয়। আধুনিক হিন্দুধর্মের বহু বিশ্বাসই আসলে মধ্যযুগীয় এবং ঔপনিবেশিক যুগের নির্মাণ।
অতএব, ধর্মীয় পরিচয় এবং ইতিহাসের প্রকৃত সত্য বুঝতে গেলে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সমাজের জটিলতাকে বিবেচনায় নিতে হবে—সেখানে গরু কখনো আহারের অংশ, কখনো বলির পশু, আবার কখনো ভক্তির প্রতীক।
উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ ও উৎস
- D. N. Jha, The Myth of the Holy Cow, Verso, 2002
- Romila Thapar, Early India: From the Origins to AD 1300, Penguin Books
- Patrick Olivelle (trans.), The Dharmasutras, Oxford University Press
- Louis Dumont, Homo Hierarchicus: The Caste System and Its Implications, University of Chicago Press
- Rigveda, Hymn 10.86
- Manusmriti, Chapter 3
- Asokan Rock Edicts, Archaeological Survey of India
আপনার মতামত জানানঃ