গবেষকরা বলছেন, মহাবিশ্ব কীভাবে ছড়াতে শুরু করল সেটা না ভেবে, আগে কল্পনা করা যেতে পারে, সবকিছু যদি ভেঙে এক জায়গায় জমাট বাঁধত, তাহলে কী হত।
বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ হচ্ছে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত সেই মুহূর্ত, যার মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছিল। বিশালাকার এই বিস্ফোরণের ফলে স্থান, সময় ও সকল পদার্থ তৈরি হয়েছিল।
তবে নতুন এক তত্ত্ব এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছে, বিগ ব্যাং হয়তো মহাবিশ্বের প্রকৃত শুরু ছিল না, বরং মহাবিশ্ব হয়তো বিশাল এক মহাকর্ষীয় পতনের ফল, যা ব্লাক হোল তৈরি হওয়ার পরের এক মহাজাগতিক ‘বাউন্স’।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগ ব্যাং হয়তো মহাবিশ্বের শুরু নয়। হতে পারে এই মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে কোনো এক বিশালাকার ব্ল্যাক হোলের ভেতরেই।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ ডি’-তে। গবেষণায় পদার্থবিদরা প্রস্তাব করেছেন, ব্লাক হোলের ভেতরে তৈরি হতে পারে মহাবিশ্ব।
এ ‘ব্লাক হোল মহাবিশ্ব’ ধারণাটি অবাস্তব শোনালেও এটি সুপরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই গঠিত।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের টুল ব্যবহার করে তত্ত্বটি তৈরি করেছেন গবেষকরা, যার জন্য অতিরিক্ত মাত্রা বা অজানা শক্তি ক্ষেত্রের মতো কোনো অদ্ভুত ও অনুমাননির্ভর উপাদানের প্রয়োজন নেই বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
বহু বছর ধরে মহাবিশ্বতত্ত্বের আদর্শ মডেলের ওপর নির্ভর করে আসছেন বিজ্ঞানীরা, যা বিগ ব্যাং দিয়ে শুরু হয় ও ‘ইনফ্লেশন বা বিস্তার’ নামে পরিচিত প্রাথমিক সম্প্রসারণের একটি পর্যায়। মহাবিশ্বের গঠন ও সম্প্রসারনের খুব ভালো ব্যাখ্যা মিলেছে মডেলটি থেকে।
তবে এই তত্ত্বে কিছু বড় প্রশ্নের উত্তর নেই। যেমন– বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ঘটেছিল, মহাবিশ্বে হঠাৎ এত দ্রুত বিস্তার বা ইনফ্লেশন কেন হয়েছিল ও কেন মহাবিশ্ব এত সমান ও মসৃণ দেখায়।
বিগ ব্যাংয়ের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে, এর সিঙ্গুলারিটি অর্থাৎ শুরুতে এটি ছিল একটি বিন্দু, যেখানে সবকিছু ছিল অসীমভাবে ঘন ও পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়ম যেখানে কাজ করে না। ফলে মহাবিশ্বের একেবারে শুরুতে কী ঘটেছিল, তা বোঝা খুবই কঠিন।
নতুন গবেষণায় এ তত্ত্বটিকে অন্যভাবে চিন্তা করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, মহাবিশ্ব কীভাবে ছড়াতে শুরু করল সেটা না ভেবে, আগে কল্পনা করা যেতে পারে, সবকিছু যদি এক জায়গায় জমাট বাঁধত, তাহলে কী হত।
বিশাল পরিমাণের পদার্থ জমাটবদ্ধ হওয়ার ফলে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়– এটি বিজ্ঞানীরা ভালোই বোঝেন। তবে একটি ব্লাক হোলের ভেতরে কী ঘটে তা এখনও রহস্যময়।
গবেষকদের হিসাব অনুসারে, ব্ল্যাক হোল ধ্বংস হলে এর ভেতরের চরম পরিস্থিতিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘কোয়ান্টাম এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল’ নামের এক নিয়ম পদার্থকে একদম শেষ পর্যন্ত ভেঙে যেতে বাধা দেয়। ফলে পদার্থের জমাটবাঁধার গতি ধীর হয় ও উল্টো দিকে ঘুরে যায়। এমন ঘটনা ‘বাউন্স’ তৈরির মাধ্যমে নতুন এক সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব গঠন করে।
গবেষকেরা বলছেন, এই ‘বাউন্স’ দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের শুরুটার মতোই। তাদের হিসাব অনুসারে, কোনো অদ্ভুত বা অজানা শক্তি ছাড়াই মহাবিশ্বের শুরুতে দ্রুত প্রসার বা ইনফ্লেশন ও এখনকার সময় মহাবিশ্বের ধীরে ধীরে দ্রুত বাড়ার কারণ বুঝাতে পারে এটি।
এ তত্ত্ব কিছু পরীক্ষার ফলাফলও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। যেমন– মহাবিশ্ব পুরোপুরি সমতল না, একটু বাঁকা হবে। ভবিষ্যতে যদি ইউক্লিড টেলিস্কোপের মতো কোনোও মহাকাশ যন্ত্র এই কথা সত্যি প্রমাণ করে তাহলে এই বাউন্স তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমাণিত হতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, তত্ত্বটি মহাবিশ্বের কিছু অন্য জটিল প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে। যেমন– বড় বিভিন্ন ব্ল্যাক হোলের শুরু কীভাবে হল বা বিভিন্ন ছায়াপথ কীভাবে গঠিত হল। ওই সময়ের কিছু অবশিষ্ট বস্তু আজও মহাবিশ্বে থাকতে পারে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ধারণা হচ্ছে, পুরো মহাবিশ্বই হয়ত অন্য কোনও মহাবিশ্বের একটি ব্ল্যাক হোলের ভেতরেই রয়েছে। এমনটি হলে বিগ ব্যাং মহাবিশ্বের শুরু নয়, বরং পরিবর্তনের একটি ধাপ। যেমন– আগে ভাবা হত পৃথিবী সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে, পরে বোঝা গেল এটি বড় একটি সিস্টেমের ছোট এক অংশ। তেমনই হয়ত মহাবিশ্বও বড় কোনও মহাজাগতিক চক্রের অংশ, যা কোয়ান্টাম নিয়ম মেনে চলে।
আপনার মতামত জানানঃ