লন্ডনের অভিজাত ডরচেস্টার হোটেলে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দৃশ্যের অবতারণা হলো। মুখোমুখি বসলেন দুই গুরুত্বপূর্ণ নাম—প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টার দিকে শুরু হওয়া এই বৈঠক ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনার পারদ চড়েছিল আগেই। বৈঠকের পরই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আর তাঁদের হাত ধরেই প্রকাশ পেল সেই বহুল প্রত্যাশিত যৌথ ঘোষণা।
ঘোষণায় স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলল যে, ভোট আসছে—সম্ভবত আগামী রমজানের আগে, অর্থাৎ মার্চ কিংবা ফেব্রুয়ারিতে। তারেক রহমান সরাসরিই রমজানের আগে ভোট চান। অন্যদিকে ইউনূস জানান, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রোজার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন সম্ভব। তবে তার জন্য চাই ‘সংস্কার ও বিচারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি’।
ঘোষণায় আরও বলা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন, রমজানের আগেই নির্বাচন হলে তা ভালো হবে। প্রধান উপদেষ্টার অবস্থানকে তারেক স্বাগত জানিয়ে ধন্যবাদ জানান। একইসঙ্গে ইউনূসও তাঁকে ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’র জন্য ধন্যবাদ জানান।
এই সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ ঘোষণার বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল চোখে পড়ার মতো। তারেক রহমান হোটেল ত্যাগের সময় দাঁড়িয়ে থাকা কর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ান, মুখে হাসি, শরীরে আত্মবিশ্বাস। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম কোনো ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে তার সরাসরি বৈঠক—তা নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা।
কে লাভবান হলো এই বৈঠকে? এই প্রশ্নটি এখন সবার মনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই পক্ষই কিছু না কিছু পেয়েছে, আবার কিছু না কিছু গিলে ফেলেছে।
তারেক রহমানের লাভ:
তাঁর দীর্ঘ নির্বাসনের পর এটি ছিল প্রথম হাই-প্রোফাইল বৈঠক, এবং সেটিও একটি ভবিষ্যতের সরকারপ্রধানের সঙ্গে। এতে করে তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
তিনি ভোটের সময়সূচির বিষয়ে ইউনূসের মুখ থেকে ‘রমজানের আগের সপ্তাহ’—এই কথাটি আনতে পেরেছেন, যা দলকে মাঠে কাজ করার সাহস দেবে।
একইসঙ্গে, তিনি দেখাতে পারলেন যে ইউনূসের ওপর তাঁর রাজনৈতিক চাপ আছে—প্রশ্নাতীত নয়।
ইউনূসের লাভ:
এক সময়ের ‘গণতন্ত্রের পতাকাবাহী’ বিএনপির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলেন। নির্বাচনের আগে একটি বৃহত্তর ঐক্যের জন্য এটি ছিল একটি চাবিকাঠি।
ভোটের সময় পেছানোর গোপন ইচ্ছাকে ‘সংস্কার এবং বিচার অগ্রগতির’ মতো যুক্তি দিয়ে জায়েজ করলেন। তার মানে হলো, তিনি চাইলে ভোট রোজার আগেই করতে পারেন, আবার চাইলে পেছাতেও পারেন।
ইউনূস কি কোনো সমঝোতা করলেন?
এই বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি ভোটের সময়সূচি কিছুটা নমনীয় রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন সম্ভব, তবে সব প্রস্তুতি থাকলে রোজার আগের সপ্তাহেও ভোট হতে পারে।” অর্থাৎ তিনি এখনো কোনো নির্দিষ্ট তারিখে অঙ্গীকারবদ্ধ হননি।
এতে বোঝা যায়, ইউনূস হয়তো এই মুহূর্তে সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছেন। যেমন, আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে চাচ্ছেন তিনি ভোটে আগ্রহী; আবার সময় নিয়ে নিজের অবস্থানও শক্ত করছেন। সেক্ষেত্রে বলা যায়, এটি একটি কৌশলগত সমঝোতা—যেখানে তিনি কিছু বলেও অনেক কিছু না বলার সুবিধা রেখে দিয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হলো?
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বৈঠক একটি ইতিবাচক সংকেত বটে। কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে এমন একটি সংলাপ আশার আলো দেখায়। অন্তত বিরোধী দলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসা একটি সঙ্কট নিরসনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। বিশেষ করে যখন রাস্তায় আন্দোলন চলছে, গ্রেপ্তার-হয়রানির অভিযোগ উঠছে, তখন এমন একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠক জনমনে স্বস্তি আনে।
তবে বাস্তবতার নিরিখে বললে, এখনো কোনো চূড়ান্ত দিন-তারিখ নির্ধারিত হয়নি, বরং বলা হয়েছে “প্রস্তুতির অগ্রগতি হলে” নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসতে পারে। সুতরাং এখনো সবকিছু অনিশ্চয়তার আবরণেই।
তাহলে নির্বাচন কবে হতে পারে?
যৌথ ঘোষণায় যেসব সময়সীমা উঠে এসেছে তা হলো— এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে (প্রধান উপদেষ্টার আগের ঘোষণা), অথবা রমজানের আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেও হতে পারে। রমজান ২০২৬ সালে শুরু হওয়ার কথা মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে, ফলে ধরে নেওয়া যায় ভোট ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে—যদি কোনো অঘটন না ঘটে।
এই বৈঠককে কেউ দেখছেন ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ হিসেবে, কেউ বলছেন ‘সমঝোতার পথ প্রশস্ত করার প্রথম ধাপ’। তবে এখনো বলার মতো কোনো বড় রাজনৈতিক সমাধান আসেনি। নির্বাচনের সময় সামনে এগিয়ে এলেও, রাজনৈতিক পরিবেশ কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে, তাতে জনগণের আস্থা কতটা ফেরানো যাবে—এই সব প্রশ্ন এখনো উত্তরহীন।
তবুও এত দিন পর ক্ষমতার ছায়া থেকে দূরে থাকা দুই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের এই মুখোমুখি হওয়া নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক বার্তা—যেখানে হয়তো সুর মিলছে, কিন্তু স্বর এখনো দ্বিধাগ্রস্ত।
আপনার মতামত জানানঃ