ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত মূলত এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জাতিসংঘসহ নানা জায়গা থেকে উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু যদি এই আহ্বান উপেক্ষিত হয়? যদি সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র হয়? এই প্রতিবেদনে এমন কিছু সম্ভাব্য, ভয়াবহ পরিণতির দৃশ্যপট তুলে ধরা হলো।
আমেরিকা জড়িয়ে পড়তে পারে
যুক্তরাষ্ট্র যতই অস্বীকার করুক, ইরানের কাছে পরিষ্কার যে তারা মনে করছে, ইসরায়েলের হামলায় মার্কিন বাহিনী অন্তত পরোক্ষভাবে সম্মতি দিয়েছে।
ফলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে পারে—যেমন ইরাকের বিশেষ বাহিনীর ঘাঁটি, উপসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক ঘাঁটি, কিংবা কূটনৈতিক মিশনগুলো। যদিও হামাস ও হিজবুল্লাহ এখন অনেকটাই দুর্বল, তবে ইরানের ইরাকভিত্তিক মিলিশিয়াগুলোর অস্ত্র ও সক্ষমতা এখনো অটুট।
এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র কিছু সেনা সদস্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারা বারবার সতর্ক করেছে, যদি মার্কিন স্বার্থ বা নাগরিকের ওপর হামলা হয়, তার কঠিন পরিণতি হবে।
যদি ধরেই নিই, কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হন—যেমন তেল আবিবে বা অন্য কোথাও?
তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ আসবে প্রতিক্রিয়া জানানোর। অনেকেই বলেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-বিরোধী যুদ্ধে টানার চেষ্টা করছেন।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো—বিশেষ করে ফরদোর মতো গভীর কেন্দ্রগুলো ধ্বংসে সক্ষম বোম্বার বা ‘বানকার বাস্টার’ বোমা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই আছে।
ট্রাম্প তার ম্যাগা (MAGA) অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আর কোনো ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ শুরু করবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক রিপাবলিকান ইসরায়েলের সরকারকে সমর্থন করে, এবং এখনই ইরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সময় এসেছে—এমনটা মনে করে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধের অংশ হয়ে পড়ে, তবে তা হবে এক বিশাল মাত্রার উত্তেজনা, যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।
উপসাগরীয় দেশগুলো জড়িয়ে পড়তে পারে
ধরে নিই, ইরান ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে ব্যর্থ হলো। তখন ইরান হয়তো সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে উপসাগরীয় অঞ্চলের অবকাঠামো ও জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাতে পারে—বিশেষ করে সেই দেশগুলোতে, যাদের ইরান দীর্ঘদিন ধরে শত্রু মনে করে।
ইরান ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। ২০২২ সালে হুথি বিদ্রোহীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতেও হামলা চালায়।
পরবর্তীতে ইরান এই অঞ্চলটির কিছু দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটিয়েছে।
তবুও, অনেক উপসাগরীয় দেশে মার্কিন ঘাঁটি আছে। আবার কয়েকটি দেশ গোপনে হলেও গত বছর ইসরায়েলকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সহায়তা করেছিল।
এই দেশগুলোর ওপর হামলা হলে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা চাইতে পারে—ইসরায়েলের পাশাপাশি।
ইসরায়েল যদি ব্যর্থ হয় ইরানের পরমাণু শক্তি ধ্বংসে
যদি ইসরায়েলের এই হামলা ব্যর্থ হয়? যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো এতটাই গভীরে হয় যে তা ধ্বংস করা যায় না? যদি ৬০% মাত্রায় সমৃদ্ধ ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম—যা থেকে ১০টি বোমা বানানো সম্ভব—নিরাপদ কোনো গোপন খনিতে লুকানো থাকে?
ইসরায়েল হয়তো কিছু পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, কিন্তু কোনো বোমাই ইরানের পারমাণবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ধ্বংস করতে পারবে না।
এই পরিস্থিতি ইরানের নেতাদের আরও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে ঠেলে দিতে পারে—বিশেষ করে যদি নতুন সামরিক নেতৃত্ব আরও বেশি আক্রমণাত্মক ও কম সংযত হয়।
তাহলে ইসরায়েল হয়তো আরও আক্রমণে বাধ্য হবে, এবং এই অঞ্চলে পাল্টা-পাল্টি হামলার এক অনন্ত চক্র শুরু হবে। ইসরায়েলের ভাষায় একে বলে “ঘাস কাটা”—অর্থাৎ শত্রুকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করে দুর্বল রাখা।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধাক্কা
তেলমূল্য ইতিমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। ধরে নিই, ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, যার ফলে তেলের পরিবহন আরও সংকটাপন্ন হয়।
অন্যদিকে, আরব উপদ্বীপের বিপরীত পাশে ইয়েমেনের হুথিরা যদি আবারও লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে? হুথিরা এখনো ইরানের শেষ সক্রিয় ‘প্রক্সি’ বাহিনী—যারা অতীতে ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেনি।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটে ভুগছে। তেলের দাম বাড়লে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে—বিশেষ করে ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্যযুদ্ধে অর্থনীতি যেভাবে দুর্বল হয়েছে, তার পেছনে।
আর ভুলে গেলে চলবে না—তেলের দাম বাড়লে যিনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, তিনি হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। বাড়তি তেল বিক্রির মাধ্যমে তার যুদ্ধবাজ অর্থনীতিতে বিশাল অঙ্কের অর্থ ঢুকবে, যা ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কাজে আসবে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে
ধরে নিই, ইসরায়েল সফলভাবে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলল?
নেতানিয়াহু দাবি করেন, তার প্রধান লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা। কিন্তু গতকাল তিনি যেভাবে বললেন, তাতে পরিষ্কার—তার আরও বড় লক্ষ্য হলো ইরানে সরকার পরিবর্তন ঘটানো।
তিনি ইরানের “গর্বিত জনগণকে” বলেন, এই হামলা তাদের “মুক্তির পথ পরিষ্কার করছে”—তিনি তাদের “নির্যাতনকারী শাসনের” বিরুদ্ধে আহ্বান জানান।
ইরানে সরকার পতন হলে কিছু দেশের চোখে এটা আশীর্বাদ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যদি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে শূন্যতা তৈরি হয়। তাহলে কী হবে? যদি ইরানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়?
অনেকেই এখনো ভুলে যাননি ইরাক ও লিবিয়ার কী পরিণতি হয়েছিল, যখন সেখানকার শক্তিশালী সরকারগুলো হঠাৎ করেই ভেঙে পড়েছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই যুদ্ধ আগামী দিনে কী দিকে মোড় নেয়? ইরান কীভাবে, কতটা তীব্রভাবে পাল্টা জবাব দেয়? আর যুক্তরাষ্ট্র কতটা ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? এই দুই প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি।
আপনার মতামত জানানঃ