ধুবড়ি শহরে একের পর এক সাম্প্রদায়িক ঘটনার জেরে আসাম সরকার রাতে ‘গুলি করার নির্দেশ’ জারি করেছে। এই সিদ্ধান্ত শুক্রবার (১৩ জুন) ঘোষণা করেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। তিনি বলেন, ঈদ-উল-আযহার পর হানুমান মন্দিরের পাশে একাধিকবার গরুর মাথা ফেলে রাখার ঘটনার পর থেকেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ৭ জুন, ঈদের পরদিন। তখন ধুবড়ির হানুমান মন্দিরে একটি গরুর মাথা পাওয়া যায়। প্রথমে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তির আবেদন জানালেও, পরদিন একই জায়গায় আবার গরুর মাথা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে রাতে পাথর ছোড়ার ঘটনাও ঘটে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (RAF) ও সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (CRPF)-এর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সপ্তাহের শুরুতে ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও তা পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবুও, ধুবড়ির পরিস্থিতি এখনো অস্থির।
“এই ধরনের ঘটনা কখনোই ঘটতে দেওয়া যায় না। পবিত্র স্থান এবং মন্দিরকে অসম্মান করার বিরুদ্ধে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি,” বলেন মুখ্যমন্ত্রী শর্মা। তিনি বলেন, একটি “সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী” ইচ্ছাকৃতভাবে এই সহিংসতা উস্কে দিয়েছে এবং এলাকার সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
মুখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঈদের আগেই কয়েক হাজার গরু ধুবড়িতে আনা হয়েছিল এবং এর পেছনে রয়েছে একটি নতুন “গরু পাচারকারী মাফিয়া চক্র”। এ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘নবীন বাংলা’ নামে একটি সংগঠন ধুবড়িকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার মতো উস্কানিমূলক পোস্টার টাঙিয়েছে। তার মতে, অনলাইনে এবং বাস্তবে উগ্রপন্থীরা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
“আমি রাতে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি কেউ পাথর ছোঁড়ে এবং পুলিশ তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করে, তাহলে গুলি চালানো হবে,” বলেন হিমন্ত শর্মা। তিনি আরও বলেন, পরবর্তী ঈদে প্রয়োজন হলে তিনি নিজেই ধুবড়ির নিরাপত্তা তদারক করবেন।
“আমরা কোনো সম্প্রদায়ের একটি অংশকেও এই ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে দেব না। ধুবড়িকে হাতছাড়া হতে দেওয়া হবে না,” সাফ জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
ধুবড়ির সাম্প্রতিক সহিংসতা, গরুর মাথা ফেলে উত্তেজনা সৃষ্টি, এবং ‘নবীন বাংলা’ নামে একটি সংগঠনের বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তির পোস্টার—এই ঘটনাগুলো শুধু একটি ধর্মীয় বা আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা নয়, বরং তা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক জটিলতা, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রাজনীতি, এবং অভ্যন্তরীণ জাতিগত বিভাজনের এক গভীর প্রতিচ্ছবি।
ধুবড়ি জেলা বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম ও জামালপুর জেলার ঠিক পাশেই। এটি ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিভক্ত, এবং বহু দশক ধরে এটি অবৈধ অনুপ্রবেশ, গরু পাচার, এবং সীমান্ত অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। ধুবড়ির অধিকাংশ জনসংখ্যা বাংলাভাষী মুসলমান, যাদের একটি বড় অংশ পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে বাস্তুহারা হয়ে এসে বসতি গড়েছেন। এই জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তত্ত্ব বরাবরই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।
এই পরিস্থিতিতে যখন ঈদের ঠিক পরদিন হিন্দুদের পবিত্র হানুমান মন্দিরে গরুর মাথা পাওয়া যায়, তখন তা শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়, বরং একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের দিকে ইঙ্গিত দেয়। এরপর ‘নবীন বাংলা’ নামক সংগঠনের পোস্টার এবং মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ গোটা ঘটনাকে আরও ঘনীভূত করে তোলে।
এখানে প্রশ্ন উঠে, কেন এমন পোস্টার লাগানো হলো? এটি কি শুধুই উগ্রপন্থীদের উস্কানি, নাকি এর পেছনে রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের টানাপোড়েন? ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরায় বহু মানুষ নিজেদের সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনে করে। এদের অনেকে আজও নিজেদের পূর্ববঙ্গীয় পরিচয় বয়ে বেড়ান। এই বাস্তবতায় ‘নবীন বাংলা’র মতো একটি নাম ব্যবহার করে পোস্টার লাগানোয় দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে—প্রথমত, আসামের বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা, এবং দ্বিতীয়ত, ভারতের জাতীয়তাবাদী শিবিরকে নতুন করে উত্তেজনা ও দমননীতির সুযোগ করে দেওয়া।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর এই ধরনের উস্কানি কেন এত সংবেদনশীল? কারণ, ভারত বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারীরা আসছে এবং এতে আসামের জনসংখ্যা ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটছে। ১৯৮০’র দশকের ‘আসু আন্দোলন’ থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও জাতীয় নাগরিক তালিকা (NRC) পর্যন্ত আসামের রাজনৈতিক বাস্তবতা মূলত এই ইস্যুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ধুবড়িতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনা ভারত সরকারের জন্য একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ক্ষেত্র, অন্যদিকে তা বাংলাদেশ সরকার ও জনমনে নতুন করে অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে। যদি ‘নবীন বাংলা’ সত্যিই কোনো চক্রান্তমূলক সংগঠন হয়, তবে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আর যদি এটি কেবল রাজনৈতিক রঙ দিয়ে একটি সাধারণ অপরাধকে বড় করে তুলে ধরার চেষ্টা হয়, তাহলে তা আসামের বাঙালি মুসলমানদের ওপর দমনমূলক নীতি বাস্তবায়নের অজুহাত হতে পারে। এতে করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো বিচ্ছিন্নতা বাড়বে, এবং চরমপন্থা মাথাচাড়া দিতে পারে। আবার বাংলাদেশও এই ঘটনাকে সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের ‘অবস্থান গ্রহণ’ বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন হিসেবে দেখাতে পারে।
এই ঘটনার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো মুখ্যমন্ত্রীর ‘গুলি করার নির্দেশ’। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই নির্দেশ যদি বাস্তবে প্রয়োগ হয়, তাহলে সেটি শুধু একটি মানবিক সংকট নয়, বরং তা ভারতের সংবিধান ও আইন শাসনের মৌলিক নীতিরও লঙ্ঘন।
শেষ কথায় বলা যায়, ধুবড়ির ঘটনা শুধুমাত্র ঈদের পরে মন্দিরে গরুর মাথা পাওয়ার ইস্যু নয়—এটি একটি বৃহৎ ভৌগোলিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। সীমান্ত অঞ্চলে জাতি, ভাষা ও ধর্মের বিভাজন যে কীভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, তার একটি নিখুঁত উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই ঘটনা। ভারতের উচিত হবে বিষয়টিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, মানবিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা, যেন এই উত্তেজনা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রভাব না ফেলে।
আপনার মতামত জানানঃ