ফর্সা শব্দটির আভিধানিক ইংরেজি শব্দ হলো ফেয়ার। আভিধানিকভাবে তাই দেখা যায়, ফর্সা শব্দটি ইতিবাচক অর্থ ধারণ করে। আমরা খুব ভালো মানুষ বোঝাতে বলি সাদামনের মানুষ। কালো শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক অর্থ সংযুক্ত। অন্ধকার আর কালোকে সমার্থক দেখা হয়। কালো দিবস, কালো পতাকা, কালো রাত, কালো বা অন্ধকার জগৎ, অন্তর কালা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই যে ফর্সা আর কালো গায়ের রং, তা বিভিন্ন দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আপেক্ষিক। বাংলাদেশের একজন ফর্সা মানুষ যাকে সাদা গোত্রে চিন্তা করা হয়, সে কিন্তু পৃথিবীর সাদা মানুষের কাছে একজন ব্রাউন মানুষ। আবার বাংলাদেশের একজন কালো মানুষ পৃথিবীর কালো জাতির কাছে ব্রাউন হিসেবে গণ্য হয়। উন্নত বিশ্বে কালোদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য কালো ত্বকের মানুষদের আজকাল ডার্ক ব্রাউন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কন্যাসন্তান এমনিতেই অবহেলিত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, তার ওপর যদি ফর্সা না হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নিজের পরিবারেই সেই কালো মেয়েটি হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়ে সময় কাটায়। বাবা-মায়ের কালো মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন? তাদের ধারণা, এই কালো মেয়ের বিয়ে একটা বিরাট সমস্যা হবে বা অনেক ব্যয়বহুল হবে। যদিওবা বিয়ের সুযোগ হয়, কালো মেয়ের জন্য যৌতুকের পরিমাণ চড়া হয়ে যায়। যৌতুক দেওয়ার জন্য বা যৌতুক না দিতে পারার জন্য কত পরিবারে যে প্রাণহানিসহ করুণ ঘটনা ঘটেছে, তা কম-বেশি সবারই জানা। বিয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়। কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ভবিষ্যৎ বংশধর কালো হতে পারে, সেই আশঙ্কা!
মুখের রং ফর্সা করার জন্য নাম না-জানা বিভিন্ন ধরনের ক্রিম মেখে থাকেন নারীরা। তবে এই রং ফর্সার নামে যেসব ক্রিম বাজারে বিক্রি করা হয়; তা ত্বকের জন্য মারত্নক ক্ষতিকর। এমনকি মুখে ক্যানসার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ-ভারতের মতো শ্রীলংকায় ও দক্ষিণ এশিয়ায় আরো অনেক নারীই তাদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে আগ্রহী। গায়ের রঙ ফর্সা করতে চাওয়া অনেক নারীর মুখ পুড়ে গেছে এই রং ফর্সার ক্রিম মেখে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নারীরা জানান, এই রং ফর্সার ক্রিম ব্যবহারের ফলে তাদের মুখে প্রথমে সাদা রংয়ের ছোপ ছোপ দেখা গেল, যা পরে কালো দাগে পরিণত হয়। কারণ এই প্রসাধনী সামগ্রীগুলো কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ছিল না।
২০১৮ সালের জুন মাসে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে স্কিন কেয়ার ব্লগার সোমা বণিকের কাছে একটি মেসেজ আসে। সেটা দেখেই সোমার নিজের অল্প বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। কারণ জানেট জেমস নামের একজন তাকে স্যোস্যাল নেটওয়ার্কি প্ল্যাটফর্ম কোরায় যে মেসেজ করেন তাতে লেখা ছিল, আপনার সাহায্য দরকার। সেখানে জানেট জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি তার ত্বককে উজ্জ্বল করার জন্য দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে স্টেরয়েড বেটামেথাসোনযুক্ত একটি ক্রিম ব্যবহার করছেন। সেই সঙ্গে কীভাবে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনুভব করছেন। জানেটে লিখেছেন, যখনই আমি এটি ব্যবহার করা বন্ধ করি, আমার মুখে চুলকানি শুরু হয় এবং ছোট ছোট ফোস্কা দেখা দেয়।
জানেটের মেসেজ পরে ভারতের কলকাতার বাসিন্দা ও ব্লগার ৩৩ বছর বয়সী সোমা তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিয়েছেন। তিনি জানেটকে পরামর্শ দেন ওই ক্রিম ব্যবহার কীভাবে বন্ধ করতে হয় তা নিয়ে।
সোমা পরামর্শ দিয়ে জানেটকে আরও লেখেন, বেটামেথাসোন একটি শক্তিশালী টপিকাল কর্টিকোস্টেরয়েড ওষুধ যা সোরিয়াসিস এবং একজিমাসহ ত্বকের নানা ধরনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে একটি হল ত্বককে উজ্জ্বল করা। সোমা আরও লেখেন, এ ধরনের ক্রিম শুধুমাত্র একজন ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।
শুধু জানেট নয় ভারতের অনেক অঞ্চলেই নারীরা ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য বেটামেথাসোন এবং অন্যান্য কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিমগুলি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করছেন চিকিৎসকের কোনো ধরনের পরামর্শ ছাড়াই।
সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোমা জানান, ২০০৩ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর তখন এক প্রতিবেশী সোমার মাকে বলেছিলেন, তার মেয়েরা নতুন ক্রিম ব্যবহার করে ফর্সা হয়েছে। আপনার মেয়ে ব্যবহার করলেও ফর্সা হবে।
সোমার ভাষায়,সমাজে সাফল্যের মাপকাঠি গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করায় তার মাও প্রতিবেশীর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ে কথা স্মরণ করে সোমা বলেন, মা সেই প্রতিবেশীর কথা মতো ওষুধযুক্ত একটি ক্রিম এনে আমাকে দিয়েছিলেন সুন্দর হওয়ার জন্য।
সোমা জানান, ওই ক্রিম ব্যবহারের পর তার স্কুলের সহপাঠিরা তাকে সুন্দর বলতে শুরু করে। কিন্তু স্টেরয়েড ক্রিম ব্যবহার করার দুই মাসের মধ্যে, যখনই তিনি রোদে বের হতেন তখনই ত্বকে জ্বালাপোড়া অনুভব করতে শুরু করেন। তবে সোমা সেটা ফর্সা হওয়ার একটা প্রক্রিয়া বলে ধরে নেন। এর মধ্যে একদিন সকালে সোমা ওই ক্রিমটা লাগাতে ভুলে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে তার ত্বকে এক ধরনের র্যাশ হয়ে। এরপর ক্রিম লাগালে তা কমে যায়। এরপর সোমার মুখ চুলকাতে থাকে, ব্রণ ওঠে। এক বছর পরে সোমার মুখে চুল গজায়।
চিকিৎসার মাধ্যমে সোমার ত্বক থেকে ওই স্টেরয়েডের প্রতিক্রিয়া বন্ধ করতে ছয় বছর লেগেছিল। কিন্তু তিনি তা বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। পরবর্তীতে সরকারি চাকুরিজীবী সোমা স্কিন কেয়ার ব্লগার হন এ ধরনের সমস্যায় পরামর্শ দেওয়ার জন্যই।
মুখের রং ফর্সা করার জন্য নাম না-জানা বিভিন্ন ধরনের ক্রিম মেখে থাকেন নারীরা। তবে এই রং ফর্সার নামে যেসব ক্রিম বাজারে বিক্রি করা হয়; তা ত্বকের জন্য মারত্নক ক্ষতিকর। এমনকি মুখে ক্যানসার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ভারতের মতো বিশাল ঘনবসতি পূর্ণ দেশে স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহারের একটি পূর্ণ চিত্র উদ্ধার করা বেশ কঠিন।
তবুও, ভারতীয় নারীরা যে অজ্ঞতাবশত স্বাচ্ছন্দ্যে এই ক্রিম ব্যবহার করে চলেছেন এবং নিজেদের পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের ক্রিম ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন তা সহজেই বোঝা যায়। এছাড়া, ভারতজুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোতেও রঙ ফর্সাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় নিয়মিত; এর মাধ্যমেই নারীরা ও তাদের পরিবার প্রভাবিত হচ্ছেন এসব ক্রিম ব্যবহারে।
সাম্প্রতিক পুরো ভারত ঘুরে উত্তরের দিল্লি শহর, পূর্বে কলকাতা, পশ্চিমে আহমেদাবাদ ও দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদের ১৬ টি ফার্মেসি থেকে সিএনএন চার ধরনের টপিকাল স্টেরয়েড ক্রিম কিনতে সক্ষম হয়েছে।
সিএনএন যেসব ফার্মেসিতে গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটি ফার্মেসি থেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন চাওয়া হয়েছিল ওষুধ বিক্রির আগে। অন্যদেরকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ বিক্রির কারণ জানতে চাইলে, তারা সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শ্যাম ভার্মা দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড অপব্যবহারের উপর কাজ করছেন। তিনি ভারতজুড়ে এই ওষুধের অপব্যবহারের সঙ্গে সম্মত হয়ে সিএনএনকে বলেন, সমস্যাটি কেবল ফার্মাসিউটিক্যাল লবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি বলেন, এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরগুলোর আইনটি কার্যকর করার ইচ্ছাশক্তি ও জনবলের অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
তবে, এ ব্যাপারে ভারতের ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের মন্তব্য জানতে চাইলে সিএনএনের অনুরোধে কোনো সাড়া দেননি তারা।
ভারতে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যাপক অপব্যবহারের মূলে রয়েছে একটি রক্ষণশীল ধারণা। অধিকাংশ ভারতীয়রা মনে করেন, গায়ের রঙ ফর্সা হলে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের যোগ্য বর খুঁজে পেতে সুবিধা হয়, পাশাপাশি কালো বর্ণের মেয়ের তুলনায় ফর্সা বর্ণের মেয়ের সঙ্গে যৌতুকও কম দিলে চলে।
২০১৪ সালে দিল্লির গুরুগ্রামে আত্মহত্যা করেছিলেন এক নারী। কারণ তার শরীরের রঙ নিয়ে কটূক্তি করতেন তার স্বামী। এতে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
এর একবছর পর কলকাতার এক স্কুলশিক্ষক নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, তার শরীরের রঙের কারণে অবিরাম অপমান সহ্য করে আসছলেন তিনি। প্রতিনিয়িত তাকে বলা হতো, গায়ের রঙের কারণে কেউ তাকে বিয়ে করবেন না। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তিনিও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
চারপাশের পরিস্থিতি বিবেচনায় সোমা বণিকের মা ২০ বছর আগে প্রতিবেশীর পরামর্শ আমলে নিয়েছিলেন। সোমা বলেন, ‘আমাদের দেশে সৌন্দর্য পরিমাপ করা হয় অন্যায্য পন্থায়। আমি বিশ্বাস করি আমার মা আমাকে ফর্সা বানাতে চেয়েছিলেন যেন আমি সমাজে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা পাই’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্বক নিয়ে এই সংস্কারে লাভবান কারা? দেশি-বিদেশি কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা। তারা কালো ত্বকের মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য উপহার দিচ্ছেন রং ফর্সা করার দ্রব্যাদি। শুধু কালো নারী নয়, আরও ফর্সা হওয়ার জন্য কম কালো নারীরাও তা ব্যবহার করে। এ ছাড়া আছে সাময়িকভাবে ফর্সা দেখানোর জন্য দ্রব্যসামগ্রীর বাণিজ্য।
অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের সপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রং যা-ই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কালো ও ফর্সা ত্বকের অধিকারী উভয় নারীকেই এই চেতনা বিপ্লবে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। ফর্সা ত্বকের নারীরও গর্ব হতে হবে তার যোগ্যতায়, ত্বকের রঙের জন্য নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ