জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্বে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে এবং এক সময়কার শীতল পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হতে হতে এখন চূড়ান্ত স্পর্শ করতে যাচ্ছে বলেও অনেক বিজ্ঞানীদের মত। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার অধিভুক্ত সংস্থা গোডার্ড ইনস্টিটিউট অব স্পেস স্টাডিজ (জিআইএসএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গত ৭ বছর ধরে ধারবাহিকভাবে বেড়েছে বিশ্বের উষ্ণতা, যার চুড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেছে ২০২১ সালের জুন মাসে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে আকার বদলে যাচ্ছে মানুষের, বদলে যাচ্ছে পাখিদের আকৃতিও। কোনও প্রজাতির পাখির ক্ষেত্রে দেহ ছোট হয়ে আসছে। অথচ বড় হচ্ছে পাখনা। আবার কোনও পাখির ঠোঁট অস্বাভাবিক হারে লম্বা হচ্ছে। পরিবেশের তাপমাত্রা বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে পাখিদের এ গঠনগত পরিবর্তন হচ্ছে।
দীর্ঘ এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পাখির আকার-আকৃতি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে কোনোভাবেই খাপ খাওয়াতে পারছে না এক শ্রেণির পাখি। গরম ও শুষ্ক পরিবেশ পাখিদের জন্য সহনীয় হচ্ছে না বলে ধারণা একদল গবেষকের।
ইকোলজি লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে গবেষণায় ১৯৭৮ থেকে ২০১৬সালের মধ্যে সংগৃহীত ৫২টি উত্তর আমেরিকার পরিযায়ী পাখির প্রজাতি থেকে ৭০ হাজারেরও বেশি পাখির নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন যে ৫২ প্রজাতির পাখির দেহের আকার ৩৮-বছরের সময়কালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে।
তারা ব্যাখ্যা করছেন, শরীরের আকার বড় থাকলে, যেমন পাখিদের ক্ষেত্রে ডানা বড় হলে তা চালাতে তাদের শরীরে যে শক্তির প্রয়োজন হয়, সেই শক্তি প্রয়োগ করলে গরম পরিবেশে পাখিদের শরীরে স্ট্রেস তৈরি হয়। কিন্তু শরীর ছোট হলে এ সমস্যা হয় না। এনার্জি কম খরচ হয়। তখন তাদের শরীর দ্রুত উষ্ণ হয়ে ওঠে না। শরীর তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে।
এ বিষয়টাতেই অভিযোজিত হচ্ছে পাখির দল। ফলে দিন দিন তাদের আকার আকৃতি ছোট হয়ে যাচ্ছে বলে মত বিজ্ঞানীদের।
ইন্টিগ্রাল ইকোলজি রিসার্চ সেন্টারের বাস্তুবিজ্ঞানী এবং এ গবেষণার প্রধান লেখক ভিটেক জিরিনেক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয় উঠে এসেছে, সেটা হলো বিশ্বের বৃহত্তম চিরহরিৎ এ বনাঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, যেমন বন উজাড়ের মতো ঘটনার সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক নেই।’
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, আশির দশক থেকে প্রায় সব পাখি হালকা হয়ে গেছে। প্রতি দশকে গড়ে ২ শতাংশ ওজন হারিয়েছে বেশিরভাগ প্রজাতি। অর্থাৎ আশির দশকে একটি পাখির ওজন যেখানে ছিল ৩০ গ্রাম, এখন গড়ে তার ওজন হয়েছে ২৭ দশমিক ৬ গ্রাম।
কোনো নির্দিষ্ট একটি এলাকা নয়, বরং আমাজনের বৃহৎ এলাকার পাখির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জিরিনেক ও তার সহকর্মীরা এ গবেষণা করেন। যার অর্থ হচ্ছে, এ ঘটনা সর্বব্যাপী।
এই গবেষণার সহলেখক লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগের অধ্যক্ষ ফিলিপ স্টফার বলেন, আমাজনের সব পাখির মধ্যে যখন এমনটা ঘটেছে, তখন বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। বিশ্বজুড়ে অন্য প্রজাতিগুলোও এমন চাপের মধ্যে রয়েছে। সেসব প্রজাতির তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ না করায় তা জানা যাচ্ছে না।
আশির দশক থেকে প্রায় সব পাখি হালকা হয়ে গেছে। প্রতি দশকে গড়ে ২ শতাংশ ওজন হারিয়েছে বেশিরভাগ প্রজাতি। অর্থাৎ আশির দশকে একটি পাখির ওজন যেখানে ছিল ৩০ গ্রাম, এখন গড়ে তার ওজন হয়েছে ২৭ দশমিক ৬ গ্রাম।
এদিকে অষ্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় ধরা পড়ে, অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কিছু বদল এলেও পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে পাখিদের উপর। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন পাখিদের জীবনযাত্রা, বাসস্থান, প্রজনন প্রভৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু উষ্ণায়নের প্রভাবে সরাসরি পাখিদের দৈহিক আকার বদলে যাওয়ার বিষয়টিকে মোটেই হাল্কাভাবে নিতে নারাজ অষ্ট্রেলিয়ার গবেষকরা।
‘ট্রেন্ডস ইন ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, তাদের চোখে ধরা পড়েছে অষ্ট্রেলিয়ান টিয়ার চঞ্চু অর্থাৎ ঠোঁট বড় হয়ে যাচ্ছে। ১৮৭১ সাল থেকে হিসেব করলে এ পর্যন্ত ওই প্রজাতির টিয়ার ঠোঁটের আকার ৪ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত লম্বা হয়েছে। যা উষ্ণায়নের প্রভাব বলেই মনে করছেন তারা।
তবে পাখিদের দেহ কেন ছোট হয়ে যাচ্ছে, গবেষণায় তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে গবেষকদের ধারণা, পাখিরা মূলত ঠোঁট, কান, পা ও পাখনাকে কাজে লাগিয়ে দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করে। সেকারণেই পরিবেশের তাপমাত্রা বদলে পাখিদের মধ্যে এইসব অঙ্গপ্রতঙ্গের পরিবর্তন ঘটছে।
বিজ্ঞানী দলের প্রধান সারা রাইডিং বলেছেন, পরিবেশের তাপমাত্রার বদলের জেরে পাখিদের উপর যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তা তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে পাখিরা কীভাবে শেষপর্যন্ত মোকাবিলা করবে, তা জানা নেই তাদের।
বিজ্ঞানী সারা রাইডিংয়ের নেতৃত্বাধীন ওই গবেষক দলের আশঙ্কা, উষ্ণায়নের কুপ্রভাব যেভাবে পাখিদের উপর পড়তে শুরু করেছে, অদূর ভবিষ্যতে তা মানুষের উপরেও পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে পাখিদের মতো মানুষের আকারেও আসতে পারে কোনও অজানা পরিবর্তন।
অবশ্য এর আগে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির টুইবেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে রয়েছে মানবদেহ ক্ষুদ্রাকৃতির হওয়ার সম্পর্ক।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, বিগত দশ লাখ বছরে মানুষের দেহের গড় আকার উল্লখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে। আর এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের।
গবেষকেরা দেখেছেন, জলবায়ু-বিশেষ করে তাপমাত্রা-গত দশ লাখ বছরে মানুষের দেহের আকার বদলে বড় ভূমিকা রেখেছে। শীত ও কঠিন জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অপেক্ষাকৃত বড় শরীরের। আর অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ায় থাকা মানুষের আকার ছোট ছিলো।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্স-এর উদ্ভব হয়েছে যে ফ্যামিলি থেকে সেই হোমো জেনাস ফ্যামিলির তিনশ’রও বেশি ফসিলের মস্তিষ্ক ও শরীরের আকারের মাপ সংগ্রহ করেছিলেন তারা। এসব তথ্যের সঙ্গে গত দশ লাখ বছরের পৃথিবীর আঞ্চলিক জলবায়ু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ওই ফসিলগুলো জীবিত অবস্থায় কোন জলবায়ুতে বসবাস করেছেন তা খতিয়ে দেখেছেন গবেষকেরা।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভোলিউশনারি ইকোলোজির অধ্যাপক আন্দ্রে মনিকা বলেন, ‘এই সম্পর্ক বহু প্রাণীর ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে— এমনকি সমসাময়িক মানুষের মধ্যেও, কিন্তু এখন আমরা জানতে পারছি যে, গত দশ লাখ বছরে মানুষের শরীরের আকার পরিবর্তনে এটাই অন্যতম চালিকা শক্তি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৪
আপনার মতামত জানানঃ