করোনার জন্য লকডাউনের কারণে ভারতে অনেক বস্ত্রকল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে দেশটিতে তুলার চাহিদা কমে গেছে। বাড়ছে মজুতের পরিমাণ। অন্যদিকে তুলার নতুন মৌসুম শুরু হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদিত তুলা রফতানি করতে না পারলে চাষিরা ভালো দাম পাবেন না, এমন আশঙ্কা রয়েছে। এ আশঙ্কা থেকে ভারতীয় তুলা বাংলাদেশে রফতানির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন এ দেশের বস্ত্রকলমালিকরা।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলছে। চুক্তি হলে বছরে ভারত থেকে ১৫ লাখ বেল তুলা আসবে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এই ভারতীয় তুলা বিক্রি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে আমদানিকৃত তুলা যদি টিসিবি বিক্রি করতে না পারে, সেক্ষেত্রে সরকারের কোষাগার থেকে ভারতের রফতানিকারকদের অর্থ পরিশোধ করা হবে।
বস্ত্রকলমালিকেরা পুরো বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, বস্ত্রকলের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। সেই তুলার মানের ওপরই সুতা ও কাপড়ের মান নির্ভর করে। ক্রেতার চাহিদার ভিত্তিতে বস্ত্রকলগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে তুলা আমদানি করে। তাই কোনো নির্দিষ্ট দেশ থেকে তুলা আমদানির বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এতে বাংলাদেশ নয়, ভারতের ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভবান হবেন। আর লোকসানের আশঙ্কায় থাকবে টিসিবি।
জানা গেছে, গত ৪-৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ফোরামের সভায় ভারতের কটন করপোরেশনের (সিসিআই) মাধ্যমে বাংলাদেশে উন্নতমানের তুলা সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন একটি খসড়া চুক্তির কপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। বাণিজ্য সচিব, বস্ত্র ও পাট সচিব এবং টিসিবির চেয়ারম্যানকেও তার অনুলিপি দেওয়া হয়।
ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে চুক্তির খসড়া পাওয়ার পর টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান ২১ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানান, টিসিবি এসেনশিয়াল কমোডিটি আইন ১৯৫৭-এর আওতাভুক্ত কয়েকটি খাদ্যপণ্য ভোক্তার জন্য আমদানি, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত, সংরক্ষণ ও বিপণন করে। বিদেশ থেকে তুলা আমদানি–রফতানিসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে টিসিবি জড়িত নয়। বিষয়টি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বস্ত্র ও তাঁত শিল্প করপোরেশনের আওতাভুক্ত। টিসিবির বক্তব্য পাওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ করে। তখন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর মতামত চাওয়া হয়।
বিটিএমএ মন্ত্রণালয়কে জানায়, বস্ত্রকলমালিকেরা বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তুলা আমদানি করে। তার মধ্যে ভারতও রয়েছে। গত পাঁচ বছরে ভারত থেকে গড়ে ২২ লাখ বেলের বেশি তুলা বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে। যদিও সেই তুলার মান, মূল্য ও সরবরাহে বিভিন্ন সময় বস্ত্রকলগুলো সমস্যায় পড়েছে। বিটিএমএ আরও বলেছে, মুক্তবাজার অর্থনীতি নির্দিষ্ট একটি দেশের সঙ্গে পণ্য ক্রয় চুক্তিতে সমর্থন করে না। তাই একটি দেশ থেকে তুলা আমদানির বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘তুলা কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। পেঁয়াজ বা আলুর মতো একরকম তুলা আনলেই হবে না। ক্রয়াদেশ অনুযায়ী, একেক বস্ত্রকলের একেক গ্রেডিংয়ের তুলা প্রয়োজন হয়। টিসিবি বস্ত্রকলমালিকদের সেই চাহিদা কীভাবে বুঝবে? তা ছাড়া ভারতের তুলা দিয়ে সাদা সুতা করা যায় না। তাদের তুলা এক বছরের বেশি সময় রাখলেই শক্ত হয়ে যায়। তাই তুলা আমদানি করে টিসিবির বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ার আশঙ্কা আছে।’
বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে আপাতত তুলা আমদানি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে না। তারপরও আমরা ভারতের প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব।’
সাধারণত তুলার ওজন হিসাব করা হয় পাউন্ড ও বেলে। ৪৮০ পাউন্ডে ১ বেল তুলা। তবে ভারতে ৩৭৪ পাউন্ডে এক বেল হিসাব করা হয়। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ১ পাউন্ড তুলার গড় মূল্য ৮০ সেন্ট। সেই হিসাবে ভারত থেকে ১৫ লাখ বেল তুলা আমদানি হলে তার দাম দাঁড়াবে আনুমানিক ৪৪ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার সমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর দেশে ৭১ লাখ বেল তুলা আমদানি হয়েছে। সর্বোচ্চ ২৬ লাখ ২৭ হাজার বেল বা ৩৭ শতাংশ তুলা আফ্রিকা থেকে এসেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ বা ১৮ লাখ ৪৬ হাজার বেল তুলা ভারত থেকে আমদানি হয়েছে। তা ছাড়া কমনওয়েলথভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে বাকি তুলা আসে।
মিই/আরা/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ