চরম দারিদ্রের কবলে আফগানিস্তান। গত এক মাসের তালিবান শাসনে অনেকেরই নিয়মিত উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আফগানিস্তানের গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছেন। তার উপর দেশে এসে পড়েছে তীব্র খাদ্যসঙ্কট। আগামী দিনে এই পরিস্থিতি ঠিক কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চলেছে, তা বোঝাতে সোমবার একটি পরিসংখ্যান সামনে এনেছে ইউনিসেফ। জানিয়েছে, এমন চলতে থাকলে আগামী শীতেই আফগানিস্তানের ১০ লক্ষ শিশু খাবারের অভাবে মারা পড়তে পারে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গতকাল সোমবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর এ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন। তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানের প্রায় এক কোটি শিশু মানবিক সহায়তা পেয়ে থাকে। আর এই সহায়তায়ই বেঁচে থাকার ব্যবস্থা হয় তাদের। এই আফগান শিশুদের সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক মহল ও বিশ্বের ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। হেনরিয়েটা বলেন, ‘দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।’
১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান। এর আগে আফগান সরকারকে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থ সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করে দেয় আন্তর্জাতিক মহল। মূলত মানবাধিকার ও নারী অধিকার ইস্যুতে তালিবানের যে অবস্থান, তা বদলাতেই এ চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ আফগানদের ওপর।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তার বিষয়টি সামনে এনেছে। প্রয়োজনে তালিবান সরকারকে এড়িয়ে সেখানকার মানুষদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে তারা। এ পরিস্থিতিতে গতকাল অতিরিক্ত ৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এ অর্থ আফগানিস্তানে ব্যয় করা হবে।
এদিকে সবশেষ আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্যকার সংঘর্ষের চিত্রও তুলে ধরেছেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর। তিনি বলেন, চলতি বছর সংঘর্ষে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর অর্ধেকই নারী ও শিশু। তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দরিদ্র দেশে কীভাবে কাজ করতে হয়, সেই মৌলিক সক্ষমতা ইউনিসেফের রয়েছে। আর আফগানিস্তানে ৭০ বছর ধরে কাজ করছে সংস্থাটি। এ কারণে আমরা জানি, আফগান শিশুদের জন্য কী প্রয়োজন।’
১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান। এর আগে আফগান সরকারকে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থ সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করে দেয় আন্তর্জাতিক মহল। মূলত মানবাধিকার ও নারী অধিকার ইস্যুতে তালিবানের যে অবস্থান, তা বদলাতেই এ চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ আফগানদের ওপর।
সোমবার জেনিভায় জাতিসংঘের এক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে আফগান সংকট নিয়ে বলতে গিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘দু’দশকের যুদ্ধ শেষে সম্ভবত এখনই সবচেয়ে বড় সঙ্কটকালের মধ্যে দিয়ে চলেছে আফগানিস্তান। গত মাসে তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর থেকে দেশের দারিদ্র্যের হার বেড়েছে এবং সাধারণ সরকারি পরিসেবাগুলো ভেঙে পড়েছে। অতীতে প্রতি বছর যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
গুতেরেস জানিয়েছেন, প্রতি তিন জন আফগানের মধ্যে একজন জানেনই না ও বেলায় তারা কোথা থেকে খাবার পাবেন। বা আদৌ পাবেন কি না!
সোমবার বিকেলে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গুতেরেস বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈঠকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে ৮,৪৭৮ কোটি টাকারও বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড আফগানিস্তানে খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাতে করা নতুন তহবিলে ৫৪৩ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
তালিবানরা দ্রুততর সময়ে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিলেও অনেক আগে থেকেই খরার পাশাপাশি ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল আফগানিস্তান।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আশঙ্কা, আফগানিস্তানের ৪০% ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গমের দাম ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সাহায্য সংস্থার নিজস্ব খাদ্য মজুদ শেষ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংঘাতের ফলে সৃষ্ট যন্ত্রণা এবং তালিবানদের ক্ষমতাসীন হওয়ার আশঙ্কায় অনেক আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মী নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যারা এখনও রয়ে গেছে তাদেরও কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
সোমবার সম্মেলনের সময় তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবেলার জন্য জাতিসংঘ জরুরি তহবিলে প্রয়োজনের কথা বললেও কেবল অর্থই সংকট নিরসনের জন্যে যথেষ্ট হবে না বলেও স্বীকার করে নেয় তারা। দাতা সংস্থার কর্মীরা যেন নিরাপদে আফগানিস্তানের যে কোনো জায়গায় গিয়ে কাজ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা দিতে তালিবানদের ওপর চাপ দিচ্ছে তারা।
কিন্তু তালিবানরা সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেষ্টা করলেও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট তার বক্তব্যে জানান, তালিবানরা ক্ষমতা দখলের পর থেকে আফগানিস্তান একটি নতুন এবং বিপজ্জনক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
তিনি বলেন, “তালিবানরা নারীদের অধিকার বজায় রাখবে এমন আশ্বাসের বিপরীতে গত তিন সপ্তাহে ক্রমাগতভাবে জনসাধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নারীদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।”
দাতা সংস্থার কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তালিবানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি কিছু নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আফগানিস্তানে সহায়তার জন্য ৬০৬ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশায় গতকাল সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় দাতাদের নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করেছিল জাতিসংঘ। তবে তহবিল সংগ্রহে জাতিসংঘের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে আফগানিস্তানের জন্য ১১০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দাতারা।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি সম্প্রতি জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে প্রতি তিন জনে একজন অর্থাৎ এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ অনহারের মুখে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তারা জানেন না পরের খাবার কোথায় থেকে পাবেন। এছাড়া আরও এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
তিনি আরও বলেছেন, আফগানিস্তানে কয়েকদিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। দেশটির গম উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চরম এই খাদ্যসংকটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। আগামীতে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
ডব্লিউএফপির সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক অ্যান্থেনা ওয়েব বলেছেন, ‘প্রাপ্তবয়স্করা না খেয়ে বাচ্চাদের খাবার দেওয়া ও পরের বেলার জন্য কম করে খাওয়ার ঘটনাও দ্বিগুণ হয়েছে।’
গতকাল আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অর্থকষ্টে থাকা আফগানরা খাবার যোগাতে থালবাটি, হাঁড়ি-পাতিল, বালিশ, কম্বল বিক্রি করছেন।
বিভিন্ন দেশ থেকে এসে পৌঁছনো অনুদানের উপর এত দিন নির্ভর করেছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি। গত ২০ বছর ধরে দেশটি নিরন্তর যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। অনেকেই ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আশ্রয় হারিয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ শেষের পর আফগানিস্তানে এমন এক সরকার প্রয়োজন ছিল, যাদের আন্তর্জাতিক সংযোগ ভাল। যারা অনুদানের অর্থ কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু তালিবানি শাসনে তা সম্ভব হচ্ছে না। যে তালিবানের নামের সঙ্গে হত্যালীলা, সন্ত্রাস চালানোর ঘটনা জরিয়ে রয়েছে, তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কী ভাবে রাখা হবে তা বুঝে উঠতেই পারছে না অধিকাংশ রাষ্ট্র। অথচ প্রায় ১০০ কোটি ডলারের অনুদানের অনুমোদন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন গুতেরেস।
ধুঁকছে অর্থনীতিও। সীমান্ত পেরিয়ে যে সব বাণিজ্য নিয়মিত চলত, তা তালিবান শাসনে বন্ধ হয়েছে। ঝাঁপ পড়েছে বহু স্থানীয় ব্যবসারও। কাবুল থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বে ওয়ার্ডাক প্রদেশের এক গ্রামবাসীর কথায়, ‘এখন এলাকায় নিরাপত্তারক্ষীরা নিয়মিত পাহারা দিচ্ছেন। এতে আমরা এখন কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছি। কিন্তু গ্রামে মানুষের হাতে কোনও কাজ নেই। উপার্জন নেই।’ এর উপর আটা, ডালের মতো দৈনন্দিন খাবারের দাম বেড়েছে। ওই গ্রামবাসী বলেছেন, ‘স্থানীয় বাজারে চারগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে আটা। মাংস খাওয়া এখন বিলাসিতা। চাল-ডালের দামও বাড়ছে। তবু বেঁচে থাকতে হবে। তাই আমরা এখন কম খাওয়ার অভ্যাস করছি।’
হাসপাতালগুলি জানাচ্ছে, অপুষ্টিজনিত রোগ বরাবরই বেশি ছিল আফগানিস্তানে। যে হাসপাতালগুলিতে সেই রোগের চিকিৎসা হত, সেখানে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। এ প্রসঙ্গেই জাতিসংঘের মহাসচিবের বৈঠকে ইউনিসেফের প্রধান জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের ১ কোটি শিশু নিয়মিত খাওয়া দাওয়া বিদেশ থেকে আসা আর্থিক অনুদানের উপর নির্ভর করে। আফগানিস্তান এখন যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে, তা চলতে থাকলে এ বছরই অন্তত ১০ লক্ষ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। খাবারের অভাবে তাদের মৃত্যুও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউনিসেফ প্রধান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০২
আপনার মতামত জানানঃ