ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত সবেমাত্র ক্ষাণিকটা দম ফেলার সময় পেয়েছে, এরইমধ্যে তৃতীয় ঢেউ দরজায় জোরেসোরে কড়া নাড়ছে। ইতোমধ্যে মহারাষ্ট্রে করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে, গোটা দেশেই তৃতীয় ঢেউয়ে নাকানিচুবানির আতঙ্কে ভুগছে ভারত। এরইমধ্যে প্রাণঘাতী ভয়াবহ নিপাহ ভাইরাস আবার নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা দীর্ঘ দিন থেকেই আশঙ্কা করে আসছেন নিপাহ ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে মহামারি শুরু হতে পারে। করোনা মহামারি পরবর্তী মহামারি হিসাবে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও ভারত ইতোমধ্যে তার কবলে পড়েছে।
বিরল এই ভাইরাসটি কোভিড-১৯ ভাইরাসের চেয়েও অনেক বেশি প্রাণঘাতী। গত রবিবার ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১২ বছরের এক ছেলে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারিতে ভারতের এই রাজ্যটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মৃত্যুর আগে আরও দুইটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় শিশুটি। ফলে আরও শত শত মানুষ তার সংস্পর্শে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ১১ জনের শরীরে ইতোমধ্যে লক্ষণ দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নিপাহ ভাইরাসের আগের সংক্রমণগুলো খতিয়ে দেখে জানিয়েছে, এতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। যা করোনাভাইরাসে মৃত্যু হারের চেয়ে অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এসব প্রাদুর্ভাবে এই ভাইরাসটিকে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে দেখা গেছে, ফলে ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে মহামারি শুরু করতে পারে আশঙ্কা রয়েছে।’
ভারতের ওই শিশুটির সংস্পর্শে আসা অন্তত একশ’ মানুষকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ জনকে কেরালার একটি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এছাড়াও কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেকেন্ডারি কন্টাক্টগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন।
এদিকে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে মহারাষ্ট্রের ঘনবসতির শহর মুম্বাই-এ। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। এ অবস্থায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন মুম্বাইয়ের মেয়র কিশোরী পেদনকার।
মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) মহারাষ্ট্রে নতুন করে ৩ হাজার আটশ’ জন কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছেন। মারা গেছেন কমপক্ষে ৮৬ জন। নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ভাবাচ্ছে সরকারকে। রাজধানী মুম্বাই ও নাগপুরে সংক্রমণের চিত্রটা উপরের দিকে। অনেকেই বলছেন, তৃতীয় ঢেউয়ের দ্বারপ্রান্তে মহারাষ্ট্র। তবে মুম্বাইয়ের মেয়র বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ ইতোমধ্যে মুম্বাই-এ শুরু হয়েছে।
সবাইকে মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর গণেশ চতুর্থী। মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উৎসবের ঠিক আগেই তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার উৎকণ্ঠায় স্থানীয়রা। এমন পরিস্থিতিতে আগামী এক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে মনে করছে রাজ্য সরকার।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, কোভিডের তৃতীয় ঢেউ দ্বিতীয়ের মতো সম্ভবত ততটা মারাত্মক হবে না। কিন্তু কেরালার নতুন সংক্রমণ সেই ধারণাকে নস্যাৎ করছে। সেখানে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের হাতে রয়েছে দুটিমাত্র উপায়। ব্যাপক হারে টিকাকরণ ও কড়াভাবে করোনা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ।
ভারতে চলতি মাস থেকে নভেম্বরে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। আর প্রস্তুতি হিসেবে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালগুলোতে সংযুক্ত করা হয়েছে অতিরিক্ত শয্যা এবং সেগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ চলছে।
কেরালায় ইতোমধ্যেই এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় এ রাজ্যটিতে বর্তমানে সর্বাধিক সংখ্যক সংক্রমণ ঘটছে, যার মধ্যে বহু মানুষের টিকা দেওয়া বা আংশিকভাবে টিকা দেওয়াও রয়েছে। তবে সেখানে মৃত্যুহার জাতীয় মৃত্যুহারের চেয়ে কম।
এদিকে ভারতে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে। বুধবার (৮ আগস্ট) গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৮৭৫ জন। এ নিয়ে, দেশটিকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হলো ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৭১৮।
গতকাল মঙ্গলবারও ৩১ হাজার ২২২ জন শনাক্ত হয়েছিল এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৯০। মঙ্গলবারের তুলনায় সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। মৃত্যুও বেড়েছে ২৪ ঘণ্টায়। বুধবার গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৩৬৯ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪১১ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতদের সিংহভাগই ছিল কেরালায়। এই রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৮৯ জনের। এছাড়া মহারাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের। বাকি সব রাজ্যে দৈনিক মৃত্যু ২০-র নিচেই রয়েছে।
এর আগে, গত ৭ মে একদিনের হিসাবে সর্বোচ্চ শনাক্ত দেখেছে ভারত। এ দিন দেশটিতে ৪ লাখ ১৪ হাজারের বেশি মানুষ করোনা শনাক্ত হয়েছিল বলে জানানো হয় দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পেছনে কাজ করেছিল অতিসংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।
এর আগে, দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যু কমায় বেশ স্বস্তিতে ছিল ভারত। তবে হঠাৎই দেশটিতে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় সংশ্লিষ্টদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তৃতীয় ঢেউ বেশি আক্রমণ করবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া শুরু হবে অক্টোবরে। তার চেয়ে কম বয়সীরা টিকা পাওয়া শুরু করবে সামনের বছরের মার্চে। ফলে সরকার কিছুতেই দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ