গর্ভবতী মায়ের জরায়ু হতে অপরিণত ভ্রুণ বেরিয়ে আসাকে গর্ভপাত বলা হয়। এই গর্ভপাত স্বঃপ্রণোদিত হতে পারে আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। গর্ভপাত কৃত্রিমভাবেও করা যায় আবার প্রাকৃতিক ভাবে গর্ভকালীন জটিলতার কারণেও গর্ভপাত হয়ে থাকে।
কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে যে গর্ভপাত ঘটে তাতে কারো হাত থাকে না বিধায় সে বিষয় নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। কিন্তু কোন গর্ভবতী নারী যদি স্বঃপ্রনোদিত হয়ে নিজের গর্ভপাত ঘটান তাহলেই শুরু হয়ে যায় তুমুল বিতর্ক। এই কৃত্রিম গর্ভপাতের কথা উঠলে নীতি-নৈতিকতা, দর্শন, জীববিজ্ঞান, ধর্ম বা আইন— সব কিছুই এসে পড়ে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। উঠে পড়ে মূল্যবোধ, সরকারের দায়িত্ব ও নারী অধিকারের প্রশ্ন৷ দেশ, সমাজ, এমনকি ধর্ম অনুযায়ী বিশ্বের সর্বত্র গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনকানুন আলাদা৷ অথচ গর্ভপাত এমন একটি বিভাজক প্রসঙ্গ যে, আইন করে দু’পক্ষকে ঠাণ্ডা করা চলে না।
তবে গর্ভপাত বিতর্কের অবসান ঘটানোর মত যুগান্তকারী একটি রায় দিয়েছেন মেক্সিকোর সুপ্রিম কোর্ট। গর্ভপাতের জন্য শাস্তি দেওয়া সংবিধান-বিরোধী বলে রায় দিয়েছেন দেশটির আদালত। খবর ডয়েচে ভেলে
আদালত জানিয়েছে, গর্ভপাতের জন্য শাস্তি দেওয়া অসাংবিধানিক। শুধু তাই নয়, রায় পড়ার সময় জাস্টিস লুই মারিয়া অ্যাগুইলার বলেন, ‘মানবাধিকারকর্মীদের জন্য এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
গর্ভপাত নিয়ে মেক্সিকোর বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রয়োগ করা হতো। উত্তর রাজ্যগুলিতে গর্ভপাত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। তেমনই এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিয়েছে। আদালত জানিয়েছে, আপাতত এই রায়টি কেবলমাত্র উত্তরের ওই রাজ্যের জন্যই প্রযোজ্য হবে। তবে দেশের অন্য বিচারপতিরাও এই রায়টিকে অন্য মামলায় ব্যবহার করতে পারবেন।
মেক্সিকো সিটি, ওয়াক্সাসা, ভেরাক্রুজ এবং হিডালগো-য় আগেই গর্ভপাত স্বীকৃত ছিল। কিন্তু বাকি ২৮টি রাজ্যে গর্ভপাতের জন্য শাস্তির নির্দেশ আছে। নতুন রায় ওই রাজ্যগুলিতেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
সম্প্রতি আমেরিকার টেক্সাসে গর্ভপাত নিয়ে মামলা হয়েছিল। টেক্সাসের আদালত গর্ভপাতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গর্ভপাত করলে কড়া শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। টেক্সাস মেক্সিকোর সীমান্তে। মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে টেক্সাসের মানুষ মেক্সিকোতে এসে গর্ভপাত করাবেন।
এর আগেও গর্ভপাত করাতে স্বামীর অনুমতি নেওয়ার আর কোনো প্রয়োজন নেই বলে রায় দিয়েছিলেন ভারতের আদালত। গর্ভের সন্তান রাখবেন নাকি গর্ভপাত করাবেন, সেই সিদ্ধান্ত ওই নারীই নেবেন বলে রায় দেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
আদালত জানিয়েছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি তার গর্ভের ভ্রূণকে জন্ম দিতে না চান, তাহলে সেই সিদ্ধান্তে অন্য কারও হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীন কোনো নারীও চাইলে গর্ভের ভ্রূণের গর্ভপাত করাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তার একার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আরও জানিয়েছেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য একজন নারীর মানসিক প্রস্তুতি দরকার। অপ্রত্যাশিত সন্তানের জন্ম নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই গর্ভের সন্তান রাখবেন না-কি গর্ভপাত করাবেন তা অন্তঃসত্ত্বা একাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এদিকে বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারা পর্যন্ত গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন ও সাজার কথা বলা হয়েছে। ৩১২ ধারায় বলা হয়েছে কোন নারী গর্ভপাত ঘটালে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি পেতে পারে।
৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্ত্রীলোকটির সন্মতি ছাড়া গর্ভপাত ঘটায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাবাস, জরিমানা বা দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
৩১৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্ত্রীলোকটির সন্মতি ছাড়া গর্ভপাত ঘটাইবার উদ্দেশ্যেজনিত কার্যে মৃত্যু ঘটায়, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাবাস বা উপযুক্ত দন্ডে দন্ডিত হবে।
৩১৫ ধারায় বলা হয়েছে, শিশু যাহাতে জীবন্ত জন্মিতে না পারে, বা উহা যাতে জন্মের পর পর মারা যায় সেই উদ্দেশ্যে কোন কার্য করিলে উক্ত ব্যক্তি দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি পেতে পারে।
৩১৬ ধারায় বলা হয়েছে, এমন কোনো কার্য দ্বারা আসন্ন প্রসব গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু ঘটানো, যাহা অপরাধজনক প্রাণনাশ বলিয়া গণ্য হয়, এমন কোনো কার্য করিলে উক্ত ব্যক্তি দশ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানা দন্ডে দন্ডিত হবে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে সাধারণ জনমানসের মূল্যবোধে যে দেয়াল তোলা আছে, তার মূল কারণ ধর্মীয়। বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতে, গর্ভপাত মহাপাপ, নরহত্যার শামিল। এছাড়া আমাদের উপমহাদেশীয় মূল্যবোধে মাতৃত্ব এক মহান বিষয়। মাতৃত্বের এই আরোপিত মহান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে গর্ভপাতকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। মাতৃত্ব একটি জৈবিক ঘটনা, এতে জড়িত থাকে গর্ভবতীর শারীরিক মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন, ভবিষ্যৎ শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই অবাঞ্চিত গর্ভধারণ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে অসম্মান করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বিষয়টি সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
তারা বলেন, আসলে নারীর মৌলিক অধিকার পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই প্রশ্নের মুখে। ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তানের জন্ম দেওয়া যে নারীর মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম, এই ধারণাটাই স্পষ্ট নয় বেশির ভাগ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। কাজেই, গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করতে হলে মহিলাদের মর্যাদা রক্ষার লড়াইকেও স্বীকৃতি দিতে হয়! সুতরাং, বদল আসবে ঠিকই। কিন্তু অন্ধকার কাটতে সময় তো লাগবেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৬
আপনার মতামত জানানঃ