বিবাহিতদের পাশাপাশি অবিবাহিত নারীদের নিরাপদ ও বৈধ গর্ভপাতের অধিকার সমান বলে রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ঐতিহাসিক এ রায় দেয়। খবর ভারতীয় গণমাধ্যম।
এব্যাপারে কোনও বৈষম্য করাকে অসাংবিধানিক বলে ধরা হবে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এর পাশাপাশি মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্টের আওয়ায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা রয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত হবে বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টিও।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, একজন নারী বিবাহিত না বিবাহিত নন, তা কখনো তার গর্ভপাতের অধিকারের ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। এমনকি অবিবিহাতি নারীও ২৪ সপ্তাহের মধ্যে এই অধিকারের যোগ্য।
শুধু এখানেই থামেনি শীর্ষ আদালত, এমনও বলেছে যে, কোনও অবিবাহিত নারীকে গর্ভপাতের অধিকার না দেওয়া মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সমান।
এর আগে গত ৭ অগাস্ট দেশটির শীর্ষ আদালত বলেছিল, মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্টে বিবাহিত ও অবিবাহিত নারীদের পার্থক্য করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ২০ সপ্তাহ পর কোনও সিঙ্গেল নারীকে গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হয় না। যা তার ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘনের সমান।
এছাড়া তখন আদালতের তরফে এও বলা হয়, মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট এবং এই সম্পর্কিত আইনগুলি তারা খতিয়ে দেখবে যাতে অবিবাহিত মহিলারা ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতের অনুমতি পান। তা অবশ্যই চিকিৎসকের উপদেশমতো।
একজন নারী বিবাহিত না বিবাহিত নন, তা কখনো তার গর্ভপাতের অধিকারের ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। এমনকি অবিবিহাতি নারীও ২৪ সপ্তাহের মধ্যে এই অধিকারের যোগ্য।
উল্লেখ্য, গর্ভপাতের আইনের ক্ষেত্রে দিল্লি হাইকোর্টের যে রায় এসেছিল তাকে কার্যত সমালোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, ‘অবিবাহিত নারীদের গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনও ভিত্তিই নেই। যখন সেই অধিকার রয়েছে বাকি নারীদেরও।’
এছাড়াও আদালত মনে করিয়ে দেয় যে আর্টিক্যাল ২১ এর আওতায় একজন নারীর গর্ভবতী হওয়াও তার অধিকারের থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কোর্ট বলছে, কোনও নারীকে তার গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে তার স্বাধীনতা ও সায়াত্ত্ব কেড়ে নেওয়া।
প্রসঙ্গত, বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সর্বোচ্চ সময়সীমা ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত। এছাড়া ধর্ষণের শিকার, বিশেষভাবে সক্ষম বা নাবালিকা, পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সহবাসের পর কোনও অবিবাহিত নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে এসব বিশেষ ক্ষেত্রে ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করা যেত। এই পরিস্থিতিতে গত আগস্ট মাসে অ্যাপেক্স কোর্টের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়, মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৭১ অনুযায়ী যদি বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতের সময় দেওয়া যেতে পারে, তাহলে কেন একই নিয়ম অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে মানা হয় না ? এরপর আজ এই নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের।
উল্লেখ্য, ২৫ বছরের এক যুবতীর দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের। ওই নারী দিল্লি হাইকোর্টের একটি নির্দেশিকার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন।
তার বক্তব্য ছিল, তিনি অবিবাহিত হওয়ায় গর্ভপাত করতে দেওয়া হয়নি। সেই সময় তিনি ২৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অভিযোগে তিনি জানান, তার প্রেমিক বিয়ে করতে অস্বীকার করেছেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড় এবং বাবা-মা উভয়েই কৃষক। তাই, একজন সন্তানকে লালন-পালনের ক্ষমতা নেই তার। এই পরিস্থিতিতে ২১ জুলাই তাকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয় আদালত।
ওই নারীর যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তার জন্য একটি বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি আদালত কেন্দ্রকে নোটিস দেয়। তাতে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিবাহিত না বিবাহিত নন, সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলা হয়। ২৩ অগাস্ট এই মামলার রায় রিজার্ভ রাখা হয়েছিল।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে সাধারণ জনমানসের মূল্যবোধে যে দেয়াল তোলা আছে, তার মূল কারণ ধর্মীয়। বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতে, গর্ভপাত মহাপাপ, নরহত্যার শামিল। এছাড়া আমাদের উপমহাদেশীয় মূল্যবোধে মাতৃত্ব এক মহান বিষয়। মাতৃত্বের এই আরোপিত মহান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে গর্ভপাতকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। মাতৃত্ব একটি জৈবিক ঘটনা, এতে জড়িত থাকে গর্ভবতীর শারীরিক মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন, ভবিষ্যৎ শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই অবাঞ্চিত গর্ভধারণ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে অসম্মান করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বিষয়টি সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
তারা বলেন, আসলে নারীর মৌলিক অধিকার পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই প্রশ্নের মুখে। ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তানের জন্ম দেওয়া যে নারীর মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম, এই ধারণাটাই স্পষ্ট নয় বেশির ভাগ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। কাজেই, গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করতে হলে মহিলাদের মর্যাদা রক্ষার লড়াইকেও স্বীকৃতি দিতে হয়! সুতরাং, বদল আসবে ঠিকই। কিন্তু অন্ধকার কাটতে সময় তো লাগবেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ