ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষে যাত্রীবোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ২২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় ৩ জনকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং তার ১৬ ঘন্টা পর আজ সকালে আরও ১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান।
গতকাল বিকাল সোয়া ৫টার দিকে উপজেলার লইসকা বিলে এ ঘটনা ঘটে। প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে নৌকাটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ৫০ জনেরও বেশি যাত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর নৌকার ঘাট থেকে যাত্রীবাহী একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের উদ্দেশে রওনা করে। তিতাস নদের বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লইছকা বিলে বালুবাহী একটি ট্রলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
সে সময় যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটির পেছনে আরেকটি বালুবাহী ট্রলার ছিল। এটিও যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটিতে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীবাহী নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়। নৌকাটিতে শতাধিক যাত্রী ছিল।
ডুবে যাওয়া ট্রলারের যাত্রী আলী আক্তার রিজভী বলেন, বিকেল সাড়ে ৪টায় জেলার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ঘাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি সদর উপজেলার আনন্দবাজার ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে লইসকা বিল এলাকায় বিপরীত দিকে থেকে আসা একটি বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়।
আহত যাত্রীরা জানান, প্রথমে ধাক্কা দেওয়া ট্রলারটি দ্রুত পালিয়ে যায়। রাত পৌনে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন দুটি শিশু, একজন তরুণ, আটজন নারীসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করেন। পরে সদর থানার পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন।
নিহতদের মধ্যে ১৮ জনের পরিচয় জানা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের পৈরতলা এলাকার আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫) ও ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজল বেগম (৪০), দাতিয়ারা এলাকার মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মিম (১২), সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেরকপুর গ্রামের মুরাদ হোসেনের ছেলে তানভীর (৮), চিলোকুট গ্রামের আব্দুল্লাহ মিয়ার শিশু কন্যা তাকুয়া (৮), নরসিংসার গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭) ও ভাটপাড়া গ্রামের ঝারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮)।
আরও রয়েছেন, বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের জহিরুল হকের ছেলে আরিফ বিল্লাহ (২০), বেড়াগাঁও গ্রামের মৃত মালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪৭) ও তার মেয়ে মুন্নি (১০), আব্দুল হাসিমের স্ত্রী কমলা বেগম (৫২), নূরপুর গ্রামের মৃত রাজ্জাক মিয়ার স্ত্রী মিনারা বেগম (৫০), আদমপুর গ্রামের অখিল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জনী বিশ্বাস (৩০) ও পরিমল বিশ্বাসের মেয়ে তিথিবা বিশ্বাস (২) এবং ময়মনসিংহের খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম (৪৫)।
সূত্র মতে, রাত ১১টা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল থেকে ১৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মরদেহের সঙ্গে দাফনের জন্য স্বজনদের হাতে ২০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে।
নৌকা ডুবির ঘটনায় তিন জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান।
তিনি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় দুর্ঘটনাস্থলের পাশের ইউনিয়ন চরইসলামপুর থেকে তিন জনকে আটক করে বিজয়নগর থানায় সোপর্দ করেছেন স্থানীয়রা।
আটককৃতরা হলেন, বালুভর্তি ভলগেটের মাঝি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের ষোলাবাড়ি গ্রামের আফজাল মিয়ার ছেলে জামির মিয়া, তার দুই সহযোগী খোকন মিয়া ও রাসেল মিয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান জানান, এ পর্যন্ত ২১ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। বালুবোঝাই ট্রলারটি পুলিশ আটক করেছে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে এবং আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রশাস্ত বৈদ্য জানান, সুরতহাল করার পর শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হচ্ছে। প্রত্যেক পরিবারকে দাফন বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
ট্রলারডুবির ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমিনকে প্রধান করে গঠন করা ওই কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রলারের ধাক্কায় নৌকাডুবির মত দুর্ঘটনার দ্রুত এবং সঠিক তদন্ত দরকার। তদন্তে ধীরগতি এবং গাফিলতি এমন আরও ঘটনা ঘটতে সহায়ক উঠতে পারে বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশের সমস্ত নৌপথ দ্রুত সময়ে নিরাপদ করার দাবি বিশেষজ্ঞদের।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ