৭ হাজারেরও বেশি বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে মারা যাওয়া একজন শিকার-সংগ্রহকারী কিশোরীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়। আর এই দেহাবশেষের হাড়ের ডিএনএ থেকে সন্ধান মিলেছে প্রাচীন এক অজানা মানবগোষ্ঠীর। নেচার জার্নালে প্রকাশিত নতুন এ গবেষণা অনুসারে, ইন্দোনেশিয়ায় আবিষ্কৃত এ মানব বংশ এ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালে সুলাওয়েসির লিয়াং প্যানিং নামক গুহা থেকে ১৭ কিংবা ১৮ বছর বয়সী এ নারীর কঙ্কাল আবিষ্কার করেছিলেন গবেষকেরা। তাদের মতে, ৭ হাজার ২০০ বছর আগে গুহায় দাফন করা হয়েছিল তার দেহাবশেষ। এছাড়াও, সুলাওয়েসির দক্ষিণ-পশ্চিম উপদ্বীপের টোলেয়ান (প্রায় ৮ হাজার বছর আগে থেকে প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত সুলাওয়েসির বনভূমি ও পাহাড়ে বসবাসকারী এসব মানুষের রহস্যময় সংস্কৃতিকে ‘টোলেয়ানস’ নাম দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।) সংস্কৃতির অংশ ছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর হিউম্যান ইভোলিউশনের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং এ গবেষণার যুগ্ম-লেখক অ্যাডাম ব্রুম জানান, তারা প্রথম মানব ডিএনএ আবিষ্কার করেছেন এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যবর্তী দ্বীপ অঞ্চল ‘ওয়ালেসিয়া’তে।
এই আবিষ্কার তাদেরকে আধুনিক মানুষের জেনেটিক বৈচিত্র্য এবং তাদের জনসংখ্যার ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য দিয়েছে। গবেষকদের ধারণা, ৫০ হাজারেরও বেশি বছর আগে পৃথিবীর প্রথম আধুনিক মানুষেরা ইউরেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গমন করেছিল। এ যাত্রা সম্পন্নের জন্য ওয়ালেসিয়া দ্বীপপুঞ্জ, অর্থাৎ সুলাওয়েসি, লম্বক ও ফ্লোরেস-সহ আরও কিছু দ্বীপ অঞ্চল অতিক্রম করতে হয়েছিল তাদের। তবে তাদের সঠিক গতিপথ, কিংবা তারা কীভাবে এ ক্রসিং দিয়ে চলাচল করেছিল সেটি এখনো অজানা।
ব্রুম বলেন, তারা নিশ্চয়ই কোনো ধরনের অপেক্ষাকৃত অত্যাধুনিক জলযান ব্যবহার করে এ পথ পাড়ি দিয়েছিল। কারণ এ দ্বীপগুলোর মাঝে কোনো স্থলাভূমির সেতু ছিল না। এমনকি শেষ বরফযুগে যখন বৈশ্বিকভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৪০ মিটার (৪৫৯ ফুট), অর্থাৎ বর্তমানের চেয়েও কম ছিল, তখনো এ অঞ্চলটিতে দ্বীপগুলোর মাঝে কোনো সংযোগ ছিল না।
এ অঞ্চলে পাওয়া প্রাচীন সরঞ্জামাদি এবং গুহার চিত্রকর্ম থেকে বোঝা যায়, প্রায় ৪৭ হাজার বছর আগে থেকে এ দ্বীপে মানুষ বসবাস করে আসছে। কিন্তু অঞ্চলটিতে জীবাশ্মের রেকর্ড বিরল এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে প্রাচীন ডিএনএ’র কার্যকারিতা দ্রুত কমে যায়।
তবে কিশোরীর আবিষ্কৃত দেহাবশেষটির মাথার খুলির গোড়ায় অবস্থিত পেট্রাস হাড় থেকে ডিএনএ উদ্ধার করতে সক্ষম হন গবেষণার একজন প্রধান লেখিকা সেলিনা কার্লহফ। জার্মানির জেনায় ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য সায়েন্স অব হিউম্যান হিস্ট্রি-তে ডক্টরাল প্রার্থী কার্লহফ বলেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর কারণে দেহাবশেষটি বিকৃত হয়ে যাওয়ায় এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
আবিষ্কৃত দেহাবশেষ থেকে সংগৃহীত ডিএনএ থেকে জানা গেছে, ৫০ হাজার বছর আগে ওয়ালেসিয়াতে প্রবেশ করা কিশোরীটি আধুনিক মানুষের প্রথম ধারার বংশধর। ‘বৃহত্তর অস্ট্রেলিয়া’ অথবা অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির সম্মিলিত বরফ যুগের স্থলভাগের প্রাথমিক উপনিবেশের অংশ ছিল এ ধারা। ব্রুম জানান, ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া আদিম মানুষের দেহাবশেষ বর্তমানের আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান ও পাপুয়ানদের পূর্বপুরুষ।
তবে তিনি আরও জানান, কিশোরীটির জিনোম ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে দেখা গেছে, সে আংশিকভাবে এশিয়ার একটি আলাদা ও সতন্ত্র গোষ্ঠীরও বংশধর ছিল। আধুনিক আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান ও পাপুয়ানরা এ গোষ্ঠীর বংশধর না হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, আবিস্কৃত কিশোরী আদতে যে দলের সদস্য, তারা সম্ভবত বৃহত্তর অস্ট্রেলিয়ার উপনিবেশের পর এসেছিল।
ব্রুম বলেন, ‘আগে এটা মনে করা হয়েছিল, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নিওলিথিক তাইওয়ান থেকে অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষাভাষী কৃষকেরা ফিলিপিন ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রবেশের সময় এশিয়ান জিনধারী লোকেরা প্রথমবার ওয়ালেসিয়াতে আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলে আধুনিক মানুষের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ছিল বলে আভাস দিচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত এ তথ্য। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না; কারণ ওয়ালেসিয়াতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বেশ কম এবং প্রাচীন কঙ্কালের অবশিষ্টাংশও বিরল।’
এছাড়া, তার জিনোমে ‘ডেনিসোভানস’ নামক রহস্যময় ও বিলুপ্ত এক মানবগোষ্ঠীর চিহ্নও পাওয়া গেছে। পূর্বে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম থেকে জানা যায়, এ গোষ্ঠীর মানুষের অস্তিত্ব ছিল মূলত সাইবেরিয়া ও তিব্বতে।
এ বিষয়ে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞানের অধ্যাপক গবেষক জোহানেস ক্রাউস বলেন, ‘ডেনিসোভানদের জিন লিয়াং প্যানিংয়ের শিকার-সংগ্রাহকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার এ তথ্য আমাদের আগের এই অনুমানকে সমর্থন করে যে, তারা বেশ বড় ভৌগোলিক এলাকা দখল করে ছিল।’
তবে ওয়ালেসিয়ার পশ্চিমে বসবাসকারী আদিম মানুষদের ডিএনএ’র সঙ্গে নতুন আবিষ্কৃত ডিএনএ’র তুলনায় দেখা গেছে, অন্যান্যদের বেলায় ডেসিনোভান ডিএনএ’র কোনো চিহ্ন নেই। এছাড়া, কিশোরীটি যে বংশের সদস্য ছিল, তার অন্য কোনো বংশধরও বর্তমানে অবশিষ্ট নেই।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে টোবিনজেনের সেকেনবার্গ সেন্টার ফর হিউম্যান ইভোলিউশন অ্যান্ড প্যালিও-এনভায়রনমেন্টের অধ্যাপক কসিমো পোস্থ বলেন, ‘ডেনিসোভান ও আধুনিক মানুষের ভৌগোলিক বণ্টন ওয়ালেসিয়া অঞ্চলে ওভারল্যাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া, এ অঞ্চলেই সম্ভবত ডেনিসোভান এবং আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান ও পাপুয়ানদের পুর্বপুরুষেরা সংমিশ্রিত বংশধর তৈরি করেছিল।’
তবে টোলিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে আসলে কী ঘটেছে, তা গবেষকেরা জানেন না। সর্বশেষ এ আবিষ্কারটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের প্রাচীন জেনেটিক ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে উদিত ধাঁধার একটি অংশ মাত্র। ব্রুম অবশ্য আশা করেন, টোলিয়ানদের বৈচিত্র্য প্রকাশকারী আরও প্রাচীন ডিএনএ উদ্ধার করা যেতে পারে, যা থেকে জানা যাবে তাদের ‘বিস্তৃত বংশগত কাহিনী।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১১
আপনার মতামত জানানঃ