রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র সেলফোন অপারেটর হিসেবে টেলিটকের যাত্রা বিএনপি জোট সরকারের সময়ে। যন্ত্রাংশ কেনা নিয়ে শুরুতেই বিতর্কে জড়ায় প্রতিষ্ঠানটির নাম। যাত্রার ১৬ বছরেও ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি টেলিটক। মাঝের দুই বছর বাদে এ দীর্ঘ সময়ের পুরোটাই লোকসানের বৃত্তে আটকে থেকেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো টেলিটকের ব্যবসার মূল ভিত্তি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। আবার গ্রাহকদের উন্নতমানের পণ্য ও টেলিকম সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদেরও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যে জড়িত টেলিটক। টেলিটক নানাভাবে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় রিটেইলাররা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া বিপুল পরিমাণ সিম বিক্রি করছেন বলে বিটিআরসির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম ধরা পড়ার পরের দিন কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার আগেই টেলিটক আগবাড়িয়ে সিম নিষ্ক্রিয় করেছে। অবৈধভাবে কল টার্মিনেশন রোধ করার নিয়মকানুনও টেলিটক যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে না।
ঘটনার শুরু গত ৩ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন র্যাব ও বিটিআরসির পরিদর্শকদের একটি দল রাজধানীর নিউমার্কেট, তুরাগ ও মিরপুরের শাহ আলী থানা এলাকায় অভিযান চালায়। এই অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহার করা বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এ সময় তিনজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় ৩ হাজার ৪০০ সিম, যা টেলিটকের।
এরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিটিআরসি টেলিটকের রিটেইলারের সম্পৃক্ততা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত শুরু করে। গত ২৩ ও ২৪ মার্চ টেলিটকের নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার সরেজমিনে পরিদর্শন করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে অবৈধ কাজে টেলিটক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা উঠে আসে। বিটিআরসির তদন্ত দল বলেছে, অবৈধ কাজে ব্যবহার করা সিম একই ব্যক্তির অনুকূলে একই রিটেইলারের মাধ্যমে বিক্রি এবং আইএমইআইয়ের (মোবাইলফোন শনাক্তকরণ নম্বর) অনুকূলে একাধিক নম্বর বরাদ্দ করা অর্থাৎ বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন/অ্যাকটিভেশন— এ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় টেলিটকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় রিটেইলাররা কোনো ধরনের যাচাই–বাছাই ছাড়াই বিপুল পরিমাণ সিম বিপণন করে আসছে।
বিটিআরসির তদন্ত দল আরও বলেছে, টেলিটকের সেলস, ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিআরএম ডিভিশন ও সিস্টেম অপারেশন ডিভিশনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া শুধু পরিবেশক/রিটেইলার পর্যায়ে একই আইএমইআই ও জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুকূলে একাধিক সিম সিরিজ বিপণনের সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে একটি সিম বন্ধের ঘটনা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি অবৈধ ভিওআইপি অভিযানের পরের দিন সিমটি নিষ্ক্রিয় করে দেয় টেলিটক। যদিও সিমটি বন্ধের কোনো নির্দেশনা তাদের দেওয়া হয়নি। বিটিআরসির তদন্ত দল বলছে, নম্বর নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে টেলিটকের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন।
দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, প্রতারণা ও বিভিন্ন অপঃপ্রচার বন্ধে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হয়। তবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে দেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো কিছুটা সোচ্চার হলেও টেলিটকের মাধ্যমে এ ব্যবসা বেশি হচ্ছে।
একজন ব্যক্তির নামে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিবন্ধন করা সম্ভব। অথচ একটি চক্র অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায় টেলিটকের ৩ হাজার ৪০০ সিম ব্যবহার করে আসছিল। এর সঙ্গে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তাদের যোগসাজশে ভুয়া নিবন্ধনের মাধ্যমে চক্রটি এসব সিম সংগ্রহ করেছে। প্রথমবার নিবন্ধিত সিমের বায়োমেট্রিক নমুনা বিভিন্ন সময় অ্যাকটিভেশন অ্যাপে সন্নিবেশের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয় একাধিক সিম। এসব সিমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একজন গ্রাহক এক দিনেই ১৪ বার একই রিটেইলার পয়েন্টে গিয়ে বায়োমেট্র্কি নমুনা দিয়ে গভীর রাতেও (রাত ৩টা ১৮ মিনিট) দোকান খুলে আঙুলের ছাপ দিয়ে সিম সংগ্রহ করেছে, যা অবাস্তব। শুধু তা-ই নয়, একটি সিমে একই সঙ্গে ৮০টির বেশি মোবাইল নম্বর নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিল, যা স্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ এসব সিম দিয়ে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করা হয়েছে।
বিটিআরসির তদন্ত দল বলছে, একজন গ্রাহক ২৪ ঘণ্টায় ১৪ বার একই রিটেইলার পয়েন্টে গিয়ে তার আঙুলের ছাপ দিয়েছেন— এটা বাস্তবসম্মত নয়। পুরো পদ্ধতিটি ভুয়া সিম নিবন্ধন করার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে টেলিটকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সম্পৃক্ততা ও রিটেইলারের ভূমিকা সন্দেহজনক। প্রথমবার নিবন্ধিত সিমের গ্রাহকের বায়োমেট্রিক নমুনা কীভাবে অন্যান্য সময় ‘অ্যাকটিভেশন’ অ্যাপে সন্নিবেশ করা হয়, তা আরও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে বের করা দরকার বলেও মনে করে তদন্ত দল।
আগবাড়িয়ে সিম নিষ্ক্রিয় করার বিষয়ে তদন্ত দল বলেছে, এর মাধ্যমে তথ্য গোপন করায় সহায়তা করার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়।
অবৈধ কল শনাক্তের যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার হচ্ছে না জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিটকের স্থাপনায় সরেজমিন পরিদর্শক দল কর্তৃক সেলফ রেগুলেটরি লজিকসমূহ নেটওয়ার্কে চালু করে সংখ্যাধিক সিম শনাক্ত করা হয়, যা প্রতিনিয়ত টেলিটকের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে প্রয়োগ করার কথা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে টেলিটকের ওই কার্যক্রম সঠিকভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির রেগুলেটরি টিম, আইটি ও বিলিং বিভাগের অনাগ্রহ রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
টেলিটক সিম ব্যবহার করে ভিওআইপির অভিযোগ নতুন নয়। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অবৈধ ভিওআইপি শনাক্তকরণ অভিযান হয়েছে ২১টি। এতে ১১ হাজার ৮০২টি সিম জব্দ করা হয়, যার ৭৫ শতাংশই টেলিটকের।
বিটিআরসির এবারের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে যে টেলিটকের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন/অ্যাকটিভেশন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। রিটেইলারের এলাকা অনুযায়ী শনাক্ত করার পদ্ধতি না থাকায় খুব সহজেই দেশের যেকোনো জায়গা থেকে সিম নিবন্ধন করা যায়। এমনকি দুষ্টচক্র ঘরে বসেই সুবিধাজনক ব্যবস্থায় সিম নিবন্ধন করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, প্রতারণা ও বিভিন্ন অপঃপ্রচার বন্ধে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হয়। তবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে দেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো কিছুটা সোচ্চার হলেও টেলিটকের মাধ্যমে এ ব্যবসা বেশি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশ ও ব্যক্তির নিরাপত্তা জোরদার করতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হলেও অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীরা ভিন্ন কৌশলে এসব সিম সংগ্রহ করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। যদিও বিটিআরসির অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তৎপর। এরপরও টেলিটকের সিম ব্যবহার করে এ ব্যবসা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
তারা জানান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার ফলে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ীদের ফলে দেশের এমন ক্ষতি প্রত্যাশিত নয়। যারা অবৈধভাবে দেশে ভিওআইপি ব্যবসা করছে তাদের তালিকা খুব বড় নয়। সবাই সচেতন হলে ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব।
তারা বলেন, মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরও লাগাম টানা যাচ্ছে না অসাধুচক্রকে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি রেডিওলিংকের মাধ্যমে বিস্তৃত হচ্ছে এই অবৈধ ব্যবসা। ফলে এক দিকে সরকার যেমন বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে অন্য দিকে বৈধভাবে দেশে কল আনা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের ব্যবসাও মার খাচ্ছে। ফলে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ