উন্মুক্ত জলাশয় ও বিল দখল করে মাছ শিকার করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা মসজিদের নামে বিলের বিভিন্ন এলাকা ‘ইজারা’ নিয়ে নতুন কায়দায় একের পর এক বিলের উন্মুক্ত জলাশয় দখল করে যাচ্ছে। চলনবিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে বানার বাঁধ ও নেটজাল ঘিরে ‘ইজারা’র নামে বিল দখল করে মৎস্যজীবীদের মাছ শিকার করতে বাঁধা দিচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের জেলা নাটোরের সিংড়ার শেরকোল রানীনগর এলাকায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. হযরত আলী ও তার ছেলে রানার নেতৃত্বে চলছে জলাশয় দখল ও মাছ শিকারের এই কর্মসূচি। ফলে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে না পেরে এলাকার অনেক সাধারণ মৎস্যজীবী ও দিনমজুর বেকার দিনযাপন করতে হচ্ছে।
এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, সিংড়ার অধিকাংশ এলাকা চলনবিলবেষ্টিত। বিলে বর্ষার পানি নামতে শুরু করায় এলাকায় মাছ শিকারিদের তৎপরতা বেড়েছে। চলনবিলের দমদমা, জোলার বাতা, সাতপুকুরিয়া, শেরকোল রানীনগর এলাকায় বানার বাঁধ ও নেটজাল দিয়ে দখল করে রেখেছে আওয়ামী লীগ নেতা হযরত আলী ও তার কর্মীরা। জেলেরা মাছ ধরার সময় চলনবিলের বৈচিত্র্যকে মাথায় রাখেন। কিন্তু দখলদাররা পানি নষ্ট করাসহ ছোট-বড় সব ধরনের মাছ এবং কাঁকড়াও নিধন করছে। ফলে চলনবিলের জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত করে এমন অপকর্ম করায় এতে বাধা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসী ক্ষোভে ফুঁসছে।
২২ নভেম্বর ২০২০, রবিবার সরেজমিনে গিয়ে সাংবাদিকরা দেখেছেন, সিংড়ার শেরকোল রানীনগর এলাকায় জলাশয়ের দুই কিলোমিটারের বেশি অংশ নেটজালে ঘেরা। এ সময় কথা হয় বাঁধে ভাইড় পাতার কাজে ব্যস্ত শেরকোল গ্রামের খলিলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রানীনগর জামে মসজিদ থেকে বিলের এই অংশ ৭০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছেন শেরকোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. হযরত আলী ও তার ছেলে রানা। তাদের নির্দেশে বিলের এই অংশে বেড়া দেয়া হয়েছে। আর যা করছেন বিলের পানি চলাচল স্বাভাবিক রেখেই করছেন। অপরদিকে জোলার বাতা, সাতপুকুরিয়া এলাকায় মসজিদের নামে বিলে বানার বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
শেরকোল এলাকায় খোড়াজাল পাতার কাজে ব্যস্ত দেবেন্দ্রনাথ বলেন, বিলের এই অংশে প্রতিদিন শত শত দিনমজুর ও মৎস্যজীবী মাছ শিকার করে জীবিকানির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু বিল ইজারা দেয়ায় মৎস্যজীবীরা বিপাকে পড়েছেন। এভাবে উন্মুক্ত জলাশয় দখলে অনেকেই তাদের কর্ম হারাচ্ছেন। শেরকোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. হযরত আলী বিলে নেট দিয়ে বেড়া দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, তার সঙ্গে এলাকার আরও ১০ থেকে ১২ জন লোক রয়েছে। বিল ইজারা নেয়ার তথ্য ঠিক নয়, রানীনগর ভাটোপাড়া মসজিদের উন্নয়নের জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আর সামান্য কিছু টাকা দেয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান জানান, চলনবিলে বানার বাঁধ ও সুতিজাল দেয়ায় মাছ, কাঁকড়া, শামুকসহ ছোট পোকামাকড় বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রশাসনসহ বিভিন্ন দিক থেকে এলাকাবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ৮নং শেরকোল ইউপির (ইউপি) চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবিব রুবেল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তার ইউনিয়নের শেরকোল রানীনগর বিলে নেট ও বানা দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে তার কোনো লোকজন সেখানে জড়িত নন বলে জানান তিনি।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালী উল্লাহ মোল্লা বলেন, প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করে বিলের অবৈধ সোঁতিজাল ও বানার বাঁধ অপসারণ করা হচ্ছে। এরপরও কিছু এলাকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে বিল ইজারা নিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে সিংড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রকিবুল হাসান বলেন, উন্মুক্ত জলাশয় বা বিল দখল করে কেউ মাছ শিকার করতে পারবে না। যদি করে থাকে দ্রুত তা উন্মুক্ত করা হবে।
তবে সরকারি কর্মকর্তারা যে বিষয়টি জানে না এবং যদি ঘটে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে ধরনের কথা বলছেন, এটা চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জেলে-কৃষকদের হতাশ করেছে। তারা দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন।
মিই/আরা/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ