বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকার নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গরিব অসহায় ও গৃহহীন মানুষকে ঘর দিয়ে তাদের আবাসন সংকট সমাধানের লক্ষ্যেও গ্রহণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন জেলায় এই প্রকল্প চরমভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এবার ঢাকার ধামরাইয়ে ধরা পড়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। দেখা গেছে, দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর তারা না পেলেও ঘুষ দিয়ে ও রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে ঘরগুলো পেয়েছেন সচ্ছল পরিবারের লোকজন।
যাদের সামান্য জমি আছে কিন্তু টেকসই বাড়ি কিংবা আবাসন নেই, গৃহহীন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন পরিবার, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো সদস্য নেই এমন পরিবার অথবা অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অনুকূলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ধামরাই উপজেলায় ১৮টি ঘর বরাদ্দ দেয় সরকার। সরকারের এ বিশেষ প্রকল্পের এসব ঘর বিতরণও করা হয়েছে। কিন্তু এতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গরিব অসহায়দের এ ঘর বরাদ্দ দেয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন প্রবাসী, সচ্ছল ও টাকাওয়ালা ধনী ব্যক্তিরা। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের গরিব অসহায়দের জন্য দুটি ঘর বরাদ্দ হলেও তা পেয়েছেন দুই সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তি। একটি ঘর পেয়েছেন ভাড়ারিয়া মিয়াপাড়ার বাসিন্দা মঙ্গল আলীর ছেলে মো. মনোয়ার হোসেন মনু। তিনি সচ্ছল। তাছাড়া তিনি একটি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত। আরেকটি ঘর পেয়েছেন তার খালাতো বোন একই ইউনিয়নের রূপবতী গ্রামের সৌদি প্রবাসী মো. জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জুলিয়া বেগম। তিনি এলাকার ভোটারও নন বলে জানা গেছে।
সরেজমিন গিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো দেখেছে, মনোয়ার হোসেন মনুর ইটের প্রাচীরে বেষ্টিত দুই কক্ষবিশিষ্ট বারান্দাসহ একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর ও একটি চারচালা বৃহৎ আকারের টিনের ঘর রয়েছে। এরপরও তাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সরকারের প্রায় তিন লাখ টাকা মূল্যের একটি দুর্যোগসহনীয় বাসগৃহ। তিনি সরকারের ডিজাইন পরিবর্তন করে টয়লেট ও রান্নাঘরে টিনের পরিবর্তে ছাদ দিয়েছেন। বসতবাড়ি ছাড়াও নিজের নামে রয়েছে অনেক জমি। এ ব্যাপারে তার স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, সরকারের করে দেয়া বিল্ডিং ভাড়া দেয় হবে। মনোয়ার হোসেন মনু বলেন, সরকার আমাকে বিল্ডিং দিয়েছে। এতে আমি অনেক খুশি হয়েছি। সরকার ইচ্ছে করলে এ বিল্ডিং ভেঙে নিয়ে যেতে পারে। এতে আমার কোনো প্রকার ওজর আপত্তি থাকবে না।
শনিবার মনুর খালাতো বোন জুলিয়া বেগমের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় তার মা কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, জুলিয়া ১২ হাজার টাকা বেতনে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে। তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম সৌদি প্রবাসী। মনুর মাধ্যমেই জুলিয়া ঘরটি পেয়েছে। জুলিয়ার কাছ থেকে মনু টাকাও নিয়েছে। কিন্তু কত টাকা নিয়েছে তা কুলসুম বেগম জানেন না বলে জানান। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নিম্নমানের টুকরো কাঠ জোড়া দিয়ে ঘরটি নির্মাণ করে দিয়েছে সরকারের লোকেরা। ঘরে টিনও কম পড়েছে। সেটাও আমাদের কিনতে বলা হয়েছে। এখন আবার আমাদের কাছে ২০ বস্তা সিমেন্টও চেয়েছে তারা।
অপরদিকে কুল্লা ইউপি চেয়ারম্যান কালিপদ সরকার বলেন, ফোর্ডনগর এলাকায় আয়েশা বেগম নামে বহিরাগত এক নারী দুর্যোগসহনীয় ঘর পেয়েছেন। অথচ স্থানীয় দরিদ্র অসহায় গৃহহীন লোকজনের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি এ ঘর। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কুল্লা ও ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের অনেকের থাকার ঘর পর্যন্ত নেই। অথচ তাদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি সাহায্যের এসব ঘর। কিন্তু মনোয়ার হোসেন মনুর বাড়িতে দুটি ঘর থাকার পরও কীভাবে তিনি সরকারি ঘর পেলেন তা সত্যিই ভাববার বিষয়।
এ ব্যাপারে ভাড়ারিয়া ইউপি সদস্য মো. আবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বনবিভাগের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে মনু ঘর পেয়েছেন। মনু ও জুলিয়া তো সচ্ছল ও ধনী মানুষ, তারা কি করে এ ঘর পেলেন? কত গরিব অসহায় মানুষ রয়েছে এ ইউনিয়নে। তারা তো সরকারের অর্থায়নে নির্মিত এ ঘর পেলেন না। সবই হয় লোক দেখে, মুখ চিনে ও টাকার বিনিময়ে। এ বিষয়ে ভাড়ারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, কার মাধ্যমে কাকে দুর্যোগসহনীয় ঘর দেয়া হয়েছে তার কিছুই জানি না। তবে শুনেছি মনু ও জুলিয়া ঘর পেয়েছেন। তারা কীভাবে পেয়েছেন তা বলতে পারব না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে মুজিব জন্মশতবর্ষের নানা উদ্যোগই দুর্নীতির কারণে ব্যর্থ হতে চলেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে যে রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করাও সম্ভব হয় না, দলীয় কার্যক্রমও সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় না, এই ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া দল ও তার কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নামেও গরিবের সেবা করতে পারছে না, দুর্নীতিতে লিপ্ত হচ্ছে, এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার তার করণীয় ঠিক করতে হবে।
মিই/আরা/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ