দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। সেই তাদের হাতে সরকারি অর্থের নিরাপদ থাকাটাও তাই প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতে দুদকের মামলায় ১৬ জন পুলিশ সদ্যসের নাম এসেছে।
মাগুরায় সরকারি তহবিল থেকে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় আট মাস অনুসন্ধান শেষে গতকাল সোমবার মাগুরার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলাটি করেন দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল।
মামলায় পুলিশের বর্তমান ও সাবেক ১৬ জন সদস্য, সোনালী ব্যাংকের ১ জন, হিসাবরক্ষণ অফিসের ৮ জনসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। ২০১৭–২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) ও নিরাপত্তা জামানত (ডিপোজিট অ্যাগেইনস্ট ওয়ার্কস অ্যান্ড সাপ্লাই) অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ১ হাজার ৩৪৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার আসামিদের মধ্যে মাগুরার সাবেক তিনজন জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা হলেন জি এম জিল্লুর রহমান, সাইফুল ইসলাম ও সরকার রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া আজমল হোসেন, আবদুল লতিফ মিয়াসহ মাগুরা হিসাবরক্ষণ অফিসের পাঁচজন নিরীক্ষককে (অডিটর) আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া ৬ জন অবসরপ্রাপ্ত সদস্যসহ পুলিশের ১৬ জন সদস্যের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমান, ফিরোজ হোসেন ও শিপন মৃধা। অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুদক। ওয়াজেদ আলী নামের ওই ব্যক্তি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঝিনাইদহ শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত। এর বাইরে নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার মাটিয়াডাঙ্গা গ্রামের আজমল মুন্সী ও মাগুরা সদর উপজেলার সাজিয়াড়া গ্রামের শাহাদাৎ হোসেনের মেয়ে রোকাইয়া ইয়াসমিনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এই দুজনের নামের হিসাবের মাধ্যমেই পাঁচ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করা হয়েছে।
মামলার বাদী মাহফুজ ইকবাল বলেন, “২৭ জন আসামির মধ্যে অধিকাংশ পুলিশের বর্তমান ও সাবেক সদস্য। এছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাও আসামির তালিকায় আছেন।”
মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভুয়া বিল তৈরি করে বড় অঙ্কের সরকারি অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনা ঘটে।
এজাহারে বলা হয়, “আসামিরা মাগুরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে কথিত জিপিএফ, ল্যাম্প গ্র্যান্ট, ডিপোজিট এগেইনস্ট সাপ্লাইজ অ্যান্ড ওয়ার্ক নামে ভুয়া বিল করে ৮১টি অ্যাকাউন্ট পে চেক ইস্যুর মাধ্যমে ১০ কোটি ৪৪ লাখ এক হাজার ৩৪৮ টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব বিল নিয়ম অনুযায়ী মাগুরা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো হয়নি।“
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।
মাগুরা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি নজরে আসার পর অভ্যন্তরীণ তদন্তে আটজন পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতিমধ্যে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। আর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ একদিকে যেমন পুলিশের জন্য লজ্জার অপরদিকে দেশের জন্যও।
তারা বলেন, সাম্প্রতিককালে পুলিশের অপকর্মের অভিযোগ সন্ত্রাসীদের চেয়েও বেশি পরিমাণে আসছে। পুলিশের কাছে অনেকটাই জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, কর্মজীবীরা। কিছু হলেই সন্ত্রাসীদের চেয়ে ভয়ানক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হয়। যখন তখন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে লুটে যাচ্ছে প্রচুর টাকা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পুলিশবাহিনীর আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বাহিনীতে বর্তমানে কমিটমেন্ট ও রিসোর্সের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগই যে সত্য এটা সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে অর্ধলক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিন বিভাগে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি নিশ্চিত করাই হলো অপরাধ দমনের প্রথম পদক্ষেপ। আর অপরাধ দমনের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে যারা নিজেরাই অপরাধে লিপ্ত হবে, তাদের শাস্তি অধিকতর কঠোর হওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পুলিশের মতো একটি বড় বাহিনীতে নানা ধরনের ও মানসিকতার লোক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে কেউ কেউ দুর্নীতি ও অপকর্ম করবে বা করার চেষ্টা করবে, তা-ও স্বাভাবিক। এটা মোকাবিলার পথ হচ্ছে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে সদস্যদের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া, যথাযথ তদন্ত করা এবং কেউ কোনো ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাহিনী হিসেবে পুলিশকে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার নাগরিকের জন্য যে চরম ভীতিকর ও হয়রানিমূলক হতে পারে, তা মাঝেমধ্যে আমরা টের পাই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৯
আপনার মতামত জানানঃ