পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে দেশে দেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে এ বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য দিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ। এনএসও দাবি করেছে, নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থারগুলোর কাছে পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি থাকায় পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ নিরাপদে রাতে ঘুমাতে ও রাস্তায় হাঁটতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি আরও বলছে, তারা এটি পরিচালনা করে না কিংবা গ্রাহকদের সংগৃহীত উপাত্তে কোনো অ্যাকসেসও নেই। এনএসও এর মুখপাত্র বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সাহায্য ও যেকোনো ধরনের অপরাধ তদন্ত, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেগাসাস এবং এ ধরনের সকল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানান।
এনএসও কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা বিভিন্ন দেশের সরকারকে সহায্য করার জন্য এবং অন্যান্য সাইবার ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠানকে পেগাসাসের মতো প্রযুক্তি সরবরাহ করে থাকে। কারণ, অনেক সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থারগুলোর কাছে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো বিদ্বেষ নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় থাকে না। তবে সেগুলো পেগাসাসের মতো অ্যাপ দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব।
আজ শনিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলের সাবেক সাইবার গোয়েন্দাদের হাত ধরে ২০১০ সালে গড়ে ওঠে তেল আবিবভিত্তিক এনএসও গ্রুপ। এনএসও গ্রুপ হলো ইসরায়েলের তেল আবিবভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্পাইওয়্যার নির্মাতাদের অন্যতম তারা। তাদের পেগাসাস স্পাইওয়্যার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেটা সহজেই আইফোন ও অ্যানড্রয়েড ফোনে ঢুকে তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির ৪০ দেশে ৬০টি গ্রাহক রয়েছে। গ্রাহকদের সব কটিই সরকারি সংস্থা। বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাসে অফিস রয়েছে এনএসওর। গত বছর তাদের আয় ছিল ২৪ কোটি ডলারের বেশি। এই কোম্পানির বেশির ভাগ মালিকানায় রয়েছে লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নোভালপিনা ক্যাপিটাল।
তাদের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে বিশ্বের অন্তত ৪৫টি দেশে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের দ্য ওয়্যারসহ ১৭টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি একযোগে এই খবর প্রকাশ করেছে। এনএসও গ্রুপের গ্রাহক বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী দেশের সেনাবাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থা। বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে আড়ি পেতে তাদের সংগৃহীত তথ্য ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ‘ব্যাকডোর’ দিয়ে দেখতে পান বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
পেগাসাস ব্যবহার করে তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বা চেষ্টা করা হয়েছে এমন ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের তথ্যভান্ডার পেয়েছিল প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ। পরে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতা নিয়ে ওই নম্বরগুলো ধরে অনুসন্ধান চালায় বিভিন্ন দেশের ১৭টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। কয়েক মাস ধরে চলা এ অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক। কিছু নম্বর নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাবে।
এনএসও গ্রুপের গ্রাহক বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী দেশের সেনাবাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থা। বিভিন্ন ব্যক্তির ফোনে আড়ি পেতে তাদের সংগৃহীত তথ্য ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ‘ব্যাকডোর’ দিয়ে দেখতে পান বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের অন্তত ১০টি গ্রাহক সংস্থা ২০টি দেশের ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর লক্ষ্যবস্তু করেছে। এসব গ্রাহকের মধ্যে বাহরাইন, মরক্কো ও সৌদি আরবের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশ থেকে শুরু করে আছে যুক্তরাজ্য, ভারত ও মেক্সিকোর মতো গণতান্ত্রিক দেশের সরকারি সংস্থাও। এই নজরদারি ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে, ইউরোপের হাঙ্গেরি ও আজারবাইজান থেকে শুরু করে আফ্রিকার টোগো ও রুয়ান্ডার মতো সব দেশেই তা করা হয়েছে। নজরদারির আওতায় শুধু সাংবাদিক নন, রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী, ধর্মীয় নেতা, গবেষক, এনজিও কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা। এমনকি কোনো কোনো দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্য, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপরও নজরদারি চালানো হয়েছে।
এর আগেও একবার ভারতে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে এনএসও গ্রুপ বলেছিল, গুরুতর অপরাধ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের বাইরে কাজে লাগানোকে এর অপব্যবহার হিসেবে বিবেচনা করে তারা, চুক্তিতেও তার উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, ‘কোনো ধরনের অপব্যবহার ধরতে পারলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এই প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য মানবাধিকার রক্ষা, তার মধ্যে রয়েছে জীবনযাপনের অধিকার, নিরাপত্তা, ব্যক্তির চলাচলের স্বাধীনতা। সে কারণে আমরা ব্যবসা ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের নির্দেশনার মূলনীতিগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছি, যাতে সব মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের পণ্যগুলো পরিচালিত হয়, সে জন্য এই প্রচেষ্টা।’
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, নজরদারির এই প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করে না। এ ছাড়া গ্রাহকদের সংগৃহীত তথ্য তাদের দেখার সুযোগ নেই।
এনএসও গ্রুপের ওই মুখপাত্র আরও বলেন, বিশ্বের আরও অনেক সাইবার ইন্টেলিজেন্স কোম্পানির সঙ্গে মিলে এনএসও বিভিন্ন দেশের সরকারকে সাইবার জগতে গোয়েন্দাগিরির টুল সরবরাহ করেছে। কারণ, সারা বিশ্বের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্ধকারে ছিল। তাদের কাছে এমন কোনো সমাধান ছিল না, যাতে তারা ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নজরদারি করতে পারে।
সাম্প্রতিক বিতর্কের মধ্যে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে ইসরায়েল সরকার। তা ছাড়া এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের লাইসেন্স দেওয়ার পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে এনএসও গ্রুপের প্রধান নির্বাহী শালেভ হুলিও বলেছেন, ‘তদন্ত হলে খুবই খুশি হব। কারণ, আমরা নিজেদের বিষয় স্পষ্ট করার সুযোগ পাব।’
এনএসও গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, সাধারণ মানুষের স্মার্টফোনের তথ্য হাতিয়ে নিতে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয় না। শুধু সন্দেহভাজন অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর এটা দিয়ে নজরদারি করা হয়েছে।
স্মার্টফোনে আড়ি পাতার ঘটনা একযোগে প্রকাশের ভূমিকায় ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক স্যালি বুজবি বলেছেন, ‘আমাদের সমাজের সব স্তরে ডিজিটাল নজরদারি ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন প্রযুক্তিগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিপদ অতীতের যেকোনো সময়ে চেয়ে এখনই বেশি।’
পাঠকদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে স্যালি বুজবি জানিয়েছেন, যেসব ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে এক হাজারের বেশি নম্বর ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন অনুসন্ধান দলের সাংবাদিকেরা। তাদের মধ্যে অন্তত ৮৫ জন মানবাধিকারকর্মী, ৬৫ জন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী, আরব রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য, ১৮৯ জন সাংবাদিক এবং ৬০০ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। এসব ব্যক্তি ৫০টির বেশি দেশের নাগরিক। সাংবাদিকদের তালিকায় অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রয়েছেন, যাঁরা সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩০৪
আপনার মতামত জানানঃ