বিশ্বে সবচেয়ে স্পর্শকাতর, অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার তৈরি করে যেসব কোম্পানি তাদের অন্যতম এনএসও গ্রুপ। এখন তারা বহু মামলার মুখোমুখি। তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্বজুড়ে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ফোন ও কম্পিউটার হ্যাকিং করা হয়।
মূলত সৌদি নারী অধিকারকর্মী লুজাইন আল হাথলুলের আইফোনই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা নজরদারির সরঞ্জাম তথা স্পাইওয়্যার পেগাসাস প্রস্তুতকারক কোম্পানি এনএসও গ্রুপকে। তার ফোনের সূত্র ধরেই একের পর এক মামলা এবং সরকারি ব্যবস্থা নেয়া হয় গ্রুপটির বিরুদ্ধে।
এই কোম্পানির উদ্ভাবিত স্পাইওয়্যার গেপাগাস দিয়ে বিশ্বজুড়ে হ্যাকিং করা হয় বলে তথ্য বেরিয়ে আসে লুজাইন আল হাথলুলের কারণে। এটা শুরু হয়েছিল লুজাইন আল হাথলুলের আইফোনে একটি সফটওয়্যার যুক্ত করে দেয়ার মাধ্যমে।
অস্বাভাবিক একটি ভুলে এনএসও’র স্পাইওয়্যার সৌদি আরবের নারী অধিকারকর্মী লুজাইন আল হাথলুল এবং প্রাইভেসি গবেষকদের তথ্য তালাশে সহায়তা করেছিল। এর অর্থ ইসরাইলি স্পাইওয়্যার প্রস্তুতকারকরা তার আইফোন হ্যাকে সহায়তা করেছিল।
ভুল করে রহস্যজনক একটি ভুয়া ইমেজ থেকে যায় লুজাইন আল হাথলুলের ফোনে। ফলে তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এ বিষয় নিয়ে গত বছর আইনি লড়াই শুরু হয় এনএসও’র বিরুদ্ধে। সরকারগুলো উঠেপড়ে লাগে। কিভাবে প্রথমে ওই হ্যাকিং শুরু হয়েছিল তা প্রথমবার প্রকাশ করা হচ্ছে।
সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যেসব নারী অধিকারকর্মী, তার মধ্যে অন্যতম লুজাইন আল হাথলুল। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি করছেন এই অভিযোগে আটকের পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
এর কিছুক্ষণ পরেই জায়ান্ট সার্স ইঞ্জিন গুগল থেকে একটি সতর্কতামূলক ইমেইল পান তিনি। তাতে বলা হয়, রাষ্ট্র সমর্থিত হ্যাকাররা তার জিমেইল একাউন্টে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে ফোন হ্যাক হয়ে গেছে এই আতঙ্কে কানাডিয়ান ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার বিষয়ক গ্রুপ সিটিজেন ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন লুজাইন আল হাথলুল। তার মোবাইল হ্যাক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তাদেরকে অনুসন্ধান করার অনুরোধ করেন তিনি।
লুজাইন আল হাথলুলের আইফোন রেকর্ড ৬ মাস ধরে পরীক্ষা করে সিটিজেন ল্যাবের গবেষক বিল মাকজ্যাক। তিনি অপ্রত্যাশিত প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেন। বলেন, লুজাইন আল হাথলুলের ফোনে একটি নজরদারিকারি মেলওয়্যার স্থাপন করা আছে। তাতে রয়ে গেছে একটি ছবি। অথচ তা মুছে যাওয়ার কথা ছিল। এ তথ্য পাওয়ার পর এমন সাইবার হামলায় ব্যবহৃত কম্পিউটার কোড গুপ্তচরবৃত্তির হাতিয়ার হিসেবে এনএসও তৈরি করেছে এমন সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়।
মার্কজ্যাক বলেন, এই আবিষ্কারটি ছিল গেম চেঞ্জার। আমরা এমন একটি বিষয়ের সন্ধান পেয়েছি, যা ওই কোম্পানি ভেবেছিল, কারো ধরাছোঁয়ায় আসবে না তা। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপল ইনকরপোরেশন বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্র সমর্থিত হ্যাকিংয়ের শিকার ভিকটিমদের সতর্ক করে।
২০২১ সালের নভেম্বরে এনএসও’র বিরুদ্ধে মামলা করে অ্যাপল। তাদের মামলার ভিত্তি হলো সিটিজেন ল্যাব এবং লুজাইন আল হাথলুলের পাওয়া তথ্য। এতে ওয়াশিংটনও সচেতন হয়ে ওঠে। তারা জানতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধেও এনএসও’র সাইবার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ওই স্পাইওয়্যার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্পাইওয়্যার প্রস্তুতকারক শিল্প বেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তাদের উন্নতি ঘটেছে বিস্ফোরকের মতো। কারণ, বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো তাদের ফোন হ্যাকিং সফটওয়্যার কিনেছে। এই সফটওয়্যার দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নজরদারি করা হচ্ছে।
বিশেষ করে অভিজাত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা ব্যবহার করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর সাংবাদিক এবং অধিকারকর্মীদের প্রচেষ্টায় পেগাসাস প্রজেক্ট বিষয়ে ধারাবাহিক তথ্য প্রকাশ হতে থাকে। তাতে বলা হয়, কিভাবে এনএসও’র এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ফলে এনএসও এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন ওঠে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লুজাইন আল হাথলুলের ওই আবিষ্কার হলো সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির শক্তিশালী পদ্ধতির প্রথম ব্লুপ্রিন্ট। এখান থেকেই তথ্য প্রকাশিত হয় যে এনএসও’র স্পাইওয়্যার দিয়ে বিশ্বজুড়ে সাইবার হামলা চালানো হচ্ছে মোবাইল ফোনগুলোতে।
জবাবে এনএসওর মুখপাত্র বলেছেন, কোম্পানি যে পণ্য বিক্রি করে তা তারা পরিচালনা করে না। তা ব্যবহার করে সরকার, আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো। লুজাইন আল হাথলুল বা অন্য অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ওই মুখপাত্র।
তবে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন সংগঠন এসব অভিযোগ করছে। এটা হলো সাইবার গোয়েন্দাগিরির রাজনৈতিক বিরোধিতা। কিছু অভিযোগ আছে যা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অসম্ভব।
গত নভেম্বরে, মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ এনএসওকে বাণিজ্য কালো তালিকাভুক্ত করে। আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে ইসরায়েলি ফার্মের সফটওয়্যার পণ্য বিক্রি থেকে সীমাবদ্ধ করে, এর সরবরাহ চেইনকে হুমকি দেয়।
বাণিজ্য বিভাগ বলেছে যে এনএসও-র স্পাইওয়্যার ‘সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, অ্যাক্টিভিস্ট, শিক্ষাবিদ এবং দূতাবাসের কর্মীদের’ টার্গেট করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল তার প্রমাণের ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এরপর ডিসেম্বরে, ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর রন ওয়াইডেন এবং আরও ১৭ জন আইনপ্রণেতা এনএসও গ্রুপ এবং তিনটি বিদেশী নজরদারি সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার জন্য মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে সহায়তা করেছে এনএসও
এসডব্লিউ/এসএস/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ