করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। কোভিড-১৯ সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে যেখানে সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়া পার হয়ে জনজীবন ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদও মহামারি আকার দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে আমেরিকার বর্ণ বৈষম্য এখন নাজুক অবস্থায়। গত ২২ জুলাই বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গ্যালাপের জরিপে এ কথা বলা হয়েছে।
গ্যালাপের জরিপে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, বর্ণ সম্পর্ক এখন নাজুক অবস্থায়। ৫৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সম্পর্ক এখন খারাপ। মাত্র ৪২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, দুই বর্ণের লোকজনের মধ্যে এখনো সম্পর্ক ভালো বা মোটামুটি ভালো আছে।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে গ্যালাপ জানিয়েছে, দুই দশকের মধ্যে গত টানা দুই বছর দেশটির বর্ণ সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঘটছে।
২০০১ সালের জরিপে দেখা দিয়েছিল, আমেরিকার ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন মনে করতেন, তাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের সম্পর্ক খুব ভালো। ২০২১ সালে এসে কৃষ্ণাঙ্গদের এমন মনোভাব ৩৩ শতাংশে ঠেকেছে।
২০০১ সালে ৬২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গই কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হিসেবে মনে করতেন। ২০২১ সালে এসে শ্বেতাঙ্গদের মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে তাদের একটা ইতিবাচক সম্পর্ক বিরাজ করছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান মনে করেন, কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে বর্ণ সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব। একই জরিপে দেখা গেছে, বর্ণ সম্পর্কের এমন উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদী মাত্র ৪০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে গ্যালাপ বলেছে, দেশ হিসেবে আমেরিকা এখনো বর্ণবৈষম্যের মতো বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি নিয়েও আশাবাদের কথাও জরিপে উঠে এসেছে। আমেরিকার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কৃষ্ণাঙ্গ দেশটির বর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের চেপে থাকা বর্ণবৈষম্য, বর্ণবিদ্বেষ কখনোই প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয় না।
২০০১ সালের জরিপে দেখা দিয়েছিল, আমেরিকার ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন মনে করতেন, তাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের সম্পর্ক খুব ভালো। ২০২১ সালে এসে কৃষ্ণাঙ্গদের এমন মনোভাব ৩৩ শতাংশে ঠেকেছে।
বর্ণবিদ্বেষের মতো ঘটনা আইন করে নিষিদ্ধ রয়েছে এবং এ ধরনের বিদ্বেষের কারণে বহু মামলা হয়ে থাকে প্রতিবছর। কর্মক্ষেত্রে বা সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যের ওপর প্রলেপ দেওয়া মার্কিন সমাজে মাঝেমধ্যেই এ নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। হিস্পানিকসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয় লোকজনের ওপর বিদ্বেষের অভিযোগ ওঠে অহরহ।
গত বছর মেনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এ নিয়ে আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। আমেরিকার সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই বর্ণবাদ রয়েছে বলে নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি উঠেছে। এমন সম্মিলিত দাবির পক্ষে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ লোকজনই নয়, মুক্তচিন্তার আধুনিক সর্ব বর্ণের লোকজনকে যোগ দিতে দেখা গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্য ও সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই বলা যায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্য চলে আসছে। দাসত্ব প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ, ঘৃনা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে আমেরিকা কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। আব্রাহাম লিঙ্কনের শতবছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন। এরপর লুথার কিং-এর আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু লুথার কিং বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেননি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিং নিহত হন।
আমেরিকার শেকড় থেকে শিখরে বর্ণবাদ। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরতে পরতে সাদা-কালো বৈষম্য। সমাজ ব্যবস্থার গভীরভাবে প্রোথিত আছে বর্ণবাদ। সাদা-কালো বিদ্বেষ। বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদি প্রবাহ ও আমাদের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়।’
আমেরিকার ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আমেরিকার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবারও বর্ণবাদ জোরদার হচ্ছে। আমেরিকার আবাসন বিভাগেও আবার ফিরে এসেছে বর্ণবাদ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা শহরের অভিজাত অঞ্চলে বসবাস করতে পারছে না। তাই বড় শহর ছাড়া ছোট ছোট শহরে বহু-বর্ণভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মানবাধিকাররের বড় বড় বুলি আওড়ানো আমেরিকা আসলে মানবাধিকার শব্দটাকেই অপব্যবহার করেছে। নিজের দেশে মানুষের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার মানুষ পাচ্ছে না অথচ লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে মানবাধিকার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে হাজার হাজার বেসামরিক নিরপরাধ মানুষদেরকে হত্যা করে চলছে এই যুক্তরাষ্ট্র।
তারা বলেন, আমেরিকাতে যুগ যুগ ধরে শুধু চামড়া সাদা না হবার কারণে আমেরিকার নাগরিক হবার পরেও কালোরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করছে। শুধুমাত্র আফ্রিকান বা কালো চামড়ার মানুষই নয় এশীয়, চাইনিজসহ সকল ধরনের মানুষ সেখানে নাগরিকত্ব পেয়েও সব জায়গাতেই নিপীড়িত হচ্ছে শুধু চামড়া সাদা হবার না কারণে। আর যাদের চামড়ার রঙ সাদা নয় আবার নাগরিকত্ব ও পাননি, তাদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাদা বাদ দিয়ে অন্যান্য গায়ের রঙয়ের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারই ফলাফল আমরা বিগত কয়েক দিনের আমেরিকাতে সংঘঠিত হওয়া বন্দুক হামলার মাধ্যমে দেখতে পাই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ