দেশে দুর্ঘটনাজনিত কারণে পঙ্গু হয়ে যারা ভিক্ষাবৃত্তি করছেন তাদের ৮২ দশমিক ৫৪ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়া তৃতীয় পক্ষের জন্য প্রবর্তিত ‘থার্ড পার্টি’র বীমা সুবিধা তাদের কেউই পাননি। দেশের বীমা ব্যবস্থার এমনি উদ্বেগজনক অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৬৩ জন পঙ্গু ভিক্ষুকের ওপর সাক্ষাৎকারভিত্তিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার ১৯টি স্থানসহ ধামরাই, সাভার আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ (আরিচা ও পাটুরিয়া ফেরিঘাট), রাজবাড়ি (গোয়ালন্দ ফেরিঘাট), যশোর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
আজ বুধবার (১৪ জুলাই) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গণমাধ্যমে এ প্রতিবেদন পাঠায়।
জরিপের ফলাফল থেকে জানা গেছে, পঙ্গু ভিক্ষুকদের ৩২.৬৯ শতাংশ মোটরযানের (বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক্টর, ট্রলি) শ্রমিক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় পতিত হন। ১৭.৩০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন, ভটভটি, চান্দের গাড়ি, টমটম, অটোরিকশা, অটোভ্যান, প্যাডেল রিকশা, ঠেলা গাড়ি ইত্যাদি) চালানোর সময় দুর্ঘটনায় পড়েন। ৪২.৩০ শতাংশ মোটরযানের যাত্রী হিসেবে দুর্ঘটনায় পড়েন। ৭.৬৯ শতাংশ পথচারী হিসেবে রাস্তায় চলাচলের সময় দুর্ঘটনায় পতিত হন।
জরিপ প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর মোটরযান মালিকদের কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য সামান্য সহযোগিতা পেয়েছেন ১১.৫৩ শতাংশ ভুক্তভোগী।
তবে কেউই মোটরযানের তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমার মাধ্যমে কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য আত্মীয়-স্বজন ও সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন সকলেই।
দুর্ঘটনায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ২৫ শতাংশ ভুক্তভোগী, অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ৫৫.৭৬ শতাংশ। মন্তব্য করেননি ১৯.২৩ শতাংশ ভুক্তভোগী।
শুধু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন ৮৪.৬১ শতাংশ ভুক্তভোগী। চিকিৎসার কোনো এক পর্যায়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫.৩৮ শতাংশ ভুক্তভোগী।
দুর্ঘটনার সময় ৫১.৯২ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ছিল ১৩ থেকে ২৫ বছর। ৩০.৭৬ শতাংশের বয়স ছিল ২৬ থেকে ৪০ বছর এবং ১৭.৩০ শতাংশের বয়স ছিল ৪১ থেকে ৬০ বছর।
দুর্ঘটনার আগে ৩২.৬৯ শতাংশের পেশা ছিল মোটরযানের চালক-শ্রমিক। ১৭.৩০ শতাংশের পেশা ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের চালক-শ্রমিক। মুদি দোকানি ছিলেন ১৩.৪৬ শতাংশ, চা দোকানি ও হকার ৯.৬১ শতাংশ, সবজি বিক্রেতা ১১.৫৩ শতাংশ, কৃষিশ্রমিক ও নির্মাণশ্রমিক ১৫.৩৮ শতাংশ, ঘাটের মাঝি ও মৎস্যজীবী ছিলেন ৩.৮৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য পারিবারিক সম্পত্তি (জমি ও গৃহপালিত পশু) বিক্রি করেছেন ৬৫.৩৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর পরিবার। বিক্রি করার মতো তেমন সম্পত্তি ছিল না ৩৪.৬১ শতাংশ ভুক্তভোগী পরিবারের।
দুর্ঘটনার আগে আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল— এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪০.৩৭ শতাংশ বলেছেন, মোটামুটি চলছিল। ৫৯.৪২ শতাংশ বলেছেন— কষ্ট করে দিনাতিপাত করতাম।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা বাধ্যতামূলক আছে এবং এই বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে “মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স এ্যাক্ট-১৯৮৩”-তে মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত ছিল ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল।
কিন্তু দুঃখজনক যে, উক্ত আইনের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন নজির দেখা যায়নি। বীমা কোম্পানীগুলো নিয়মিত প্রিমিয়াম নিলেও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না।
বাংলাদেশে “মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স এ্যাক্ট-১৯৮৩”-তে মোটরযানে তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত ছিল ক্লেইম ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু দুঃখজনক যে, উক্ত আইনের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন নজির দেখা যায়নি। বীমা কোম্পানীগুলো নিয়মিত প্রিমিয়াম নিলেও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না।
তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরকারও কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত গরীব মানুষেরা চিকিৎসার জন্য সহায়-সম্বল বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পথের ভিখারীতে পরিণত হয়েছেন।
আবার পূর্বের আইনে কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি এই অজুহাতে সরকার “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮”-তে মোটরযানের তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা বিলোপ করে একটি “ট্রাস্ট ফান্ড” এর বিধান রেখেছে, যার সাংগঠনিক কাঠামো এবং তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল।
এই তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া খুবই দুরুহ হবে বলে আমাদের আশংকা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” প্রণয়নের এতদিন অতিবাহিত হলেও উক্ত ট্রাস্ট ফান্ড গঠনই হয়নি। অথচ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। পঙ্গু ভিক্ষুকদের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবার এবং দেখার কেউ নেই।
এদিকে যানবাহনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বা থার্ড পার্টি ইনস্যুরেন্স গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাতিল করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। বীমা ছাড়াই অবলীলায় পথে চলছে গাড়ি। এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এখন প্রথম পক্ষ বীমা বা কম্প্রিহেনসিভ ইনস্যুরেন্স পলিসি বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে কম্পানি ও মালিক উভয়েই লাভবান হবেন।
এত দিন মোটরযানের জন্য প্রথম পক্ষ বা কম্প্রেহেনসিভ বীমা এবং তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টি ইনস্যুরেন্স নামে দুই ধরনের বীমা পলিসি ছিল। প্রথম পক্ষ পলিসির আওতায় সড়কে কোনো গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই গাড়ির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেয় বীমা কম্পানি। শর্ত থাকলে, গাড়ির চালক বা যাত্রী শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
আর তৃতীয় পক্ষ পলিসিতে রাস্তায় চলতে গিয়ে একটি গাড়ি অন্য গাড়ির ক্ষতি বা কোনো ব্যক্তিকে আহত কিংবা নিহত করলে ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দিত বীমা কম্পানিগুলো। কম্প্রিহেনসিভ বীমা চালু থাকলেও গেল ডিসেম্বরে তৃতীয় পক্ষের এই পলিসিটিই বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইডিআরএ।
আইডিআরএ ও বীমা খাতের অন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যেহেতু তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু মোটরযান মালিকদের কম্প্রিহেনসিভ পলিসি বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। কারণ এই মুহূর্তে সড়কে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনো সবাই সঠিকভাবে অবগত নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪১
আপনার মতামত জানানঃ