বাংলাদেশে যে কোন পণ্য কিনতে গেলে ক্রেতাদের ঐ পণ্যের দামের সঙ্গে দিতে হয় ভ্যাট— সে খাদ্যদ্রব্য হোক বা হোক পোশাক কিংবা ইলেকট্রনিক পণ্য। অনেক ক্রেতাই এই দাম পরিশোধের সময় ভ্যাট দেন কিন্তু তারা জানেন না তাদের দেয়া অর্থটা সরকারের কোষাগারের আদৌ জমা হচ্ছে কিনা। ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই সরকারকে ওই ভ্যাট পরিশোধ করছে না। এদিকে ব্যবসা করতে গেলে ভ্যাট বিভাগের দেওয়া ব্যবসায় শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) বা ভ্যাট নিবন্ধন করা যে লাগে রাজধানী ও আশপাশের বড় বিপণিবিতানগুলোর শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এই নিবন্ধন নেই। প্রতি পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়া তাদের ব্যবসা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট গোয়েন্দাদের এক জরিপে এমনটি দেখা গেছে।
রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর নামকরা ১৭টি বিপণিবিতানে ওই জরিপ করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। গত ২৪ থেকে ৩১ মে ভ্যাট গোয়েন্দাদের চারটি দল জরিপটি চালায়।
জরিপের ফল বলছে, ভ্যাট গোয়েন্দারা বিপণিবিতানগুলোর মোট ২ হাজার ১৩৩টি দোকানে গিয়ে মাত্র ৪৮২টিতে ভ্যাট নিবন্ধন থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। বাকি ১ হাজার ৬৫১টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ৭৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই। তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট নিলেও তা সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে না। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগই থাকার কথা নয়। সম্প্রতি জরিপের ফলাফল প্রতিবেদন এনবিআরের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এদের প্রায় সকলে ক্রেতার নিকট হতে ভ্যাট আদায় করে। কিন্তু তারা যথাযথভাবে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট পরিশোধ করে না।
ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বলছে কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এদের প্রায় সকলে ক্রেতার নিকট হতে ভ্যাট আদায় করে। কিন্তু তারা যথাযথভাবে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট পরিশোধ করে না।
ভ্যাট আইন অনুসারে যে কোন ভ্যাটযোগ্য ব্যবসা শুরু করার পূর্বেই নিবন্ধন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। মার্কেটগুলোতে খুচরা পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫% হারে ভ্যাট সংগ্রহ করে প্রতি মাসের ভ্যাট পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে স্থানীয় ভ্যাট সার্কেলে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান রয়েছে।
জরিপ প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীর চেয়ে ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট প্রদানে অনীহা বেশি। এসব এলাকায় ভ্যাট আইন পরিপালন অপেক্ষাকৃত কম।
জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীর আটটি অভিজাত বিপণিবিতানের ১ হাজার ৬৪টি দোকানে জরিপ করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৪২৮টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে। অর্থাৎ, ভ্যাটের আওতায় আছে মাত্র ৪০ শতাংশ। এক দশকের বেশি সময়ের পুরোনো সুবাস্তু নজর ভ্যালি শপিং মলের ৫২৬টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৬টির ভ্যাট নিবন্ধন আছে। ধানমন্ডির সানরাইজ প্লাজায় ৫৫টি দোকানের মধ্যে মাত্র ২৫টির ভ্যাট নিবন্ধন আছে।
সাভারের দুটি বিপণিবিতানের ৪৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪১টিতে ভ্যাট নিবন্ধন থাকার তথ্য পেয়েছেন ভ্যাট গোয়েন্দারা।
নরসিংদী শহরের ইনডেক্স প্লাজার ২২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র একটিতে ভ্যাট সনদ পেয়েছেন ভ্যাট গোয়েন্দারা। আর জামান শপিং কমপ্লেক্সের ২০টি প্রতিষ্ঠানের একটিরও ভ্যাট নিবন্ধন নেই।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি বিপণিবিতানের ৩৬৬টি দোকানের মধ্যে মাত্র ১৭টিতে বা ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট নিবন্ধনের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানকার মার্ক টাওয়ারের ৩১টি দোকানের মধ্যে মাত্র একটি, সমবায় মার্কেটের ৮১টির মধ্যে মাত্র একটি দোকান ভ্যাটের আওতায় রয়েছে। এ ছাড়া ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজার ১৮৭টি দোকানের মধ্যে মাত্র আটটির ভ্যাট নিবন্ধন আছে।
তবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোও যে নিয়মিত ভ্যাট প্রদান করে থাকে এমনটি নয়। যে ৪৮২টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে, তাদের মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দেয় ৪৪৫টি। নিয়মিত রিটার্ন প্রদানকারীদের মধ্যে আবার মাসে পাঁচ হাজার টাকার বেশি ভ্যাট দেয় এমন প্রতিষ্ঠান মাত্র ১১৩টি। বাকিগুলো পাঁচ হাজার টাকার কম ভ্যাট দেয়।
এনবিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণ করেছে প্রায় ২ লাখ ৩১ হাজার প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে ৯৬ হাজার প্রতিষ্ঠান। আর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠান।
ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড.মইনুল খান বিবিসিকে জানান ‘ভ্যাট আইনে একটা বিষয় বলা আছে যে আপনি যদি নিবন্ধন করেন তাহলে আপনাকে রিটার্ন সাবমিট করতে হবে, না হলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে জরিমানা হচ্ছে। মানুষ এখন এমন একটা বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যে আছে যে আমরা এনবিআরকে কিছু বলতে পারছি না। কারণ এই জরিমানা মওকুফের এখতিয়ার এনবিআর-এর চেয়ারম্যানকেও দেয়া হয়নি’।
ভোক্তারা বলছেন ‘রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বা শপিংমলে কেনাকাটা করলে অনেক টাকার ভ্যাট দিতে হয়। এই ভ্যাট আমি দিচ্ছি কিন্তু আমাকে যে কপি দেয়ার কথা সেটা তারা দিচ্ছে না। ফলে আমার কাছে কোন প্রমাণ থাকছে না যে আমি ভ্যাট দিয়েছি। আর সেটা সরকারের কাছে যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাট নিবন্ধন থাকুক বা না থাকুক, ভোক্তাদের নিকট থেকে খাদ্য বা পণ্যের ভ্যাট নেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু উক্ত ভ্যাট সরকারকে পরিশোধ না করে নিজেদের মুনাফার সঙ্গেই যোগ করে নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে সরকারের সঠিক নজরদারি নেই বলে মধ্যস্থতাকারী একটি ব্যবসায়ীদল ফুলেফেঁপে উঠছে। অথচ জনগণের কাছ থেকে প্রতিটা পণ্যেরই ভ্যাট নেওয়া হয়ে থাকে। দেশের আইন জনগণ মানলেও সরকারের গাফিলতিতে বরাবরের মতই ব্যবসায়ীরা সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৬
আপনার মতামত জানানঃ