ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে চলমান লড়াইয়ে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ। এছাড়া আট মাস ধরে চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে আরও ১৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়ার চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। দেশটির পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম উন্মুক্ত বৈঠকে শুক্রবার এ কথা জানায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। খবর বিবিসি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইথিওপিয়ার চলমান সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার জাতিসংঘের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সংস্থাটির কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান।
এ সংকট নিয়ে ডাকা প্রথম বৈঠকে সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদ জানায়, ওই অঞ্চলের ৩৩ হাজারের বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
জাতিসংঘ বলছে, ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে টাইগ্রে অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক দল টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) এবং সরকারি বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘ সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গত আট মাসের যুদ্ধে টাইগ্রে অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের শিকার প্রায় চার লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৩৩ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
নিউইয়র্কের বৈঠকে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত প্রধান রমেশ রাজাসিংঘাম জানান, গত কয়েক সপ্তাহে টাইগ্রের নিরাপত্তা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কয়েক দশকে এত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি আমরা আর দেখিনি যেমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এ মুহূর্তে যাচ্ছে ইথিওপিয়া।’
প্রায় ৫২ লাখ মানুষের অবিলম্বে জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন তিনি। দুর্গতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও অঞ্চলটিতে নতুন করে সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
এর আগে গত সোমবার টাইগ্রেতে একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় ইথিওপিয়া সরকার। তবে বিদ্রোহীরা সেখান থেকে ‘শত্রুদের’ বিতাড়িত করার ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক মহল থেকে সব পক্ষকে সরে আসার চাপ দেয়া হলেও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর পাওযা যায়।
টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে গত নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে ইতোমধ্যে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এ ছাড়া ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সংঘাতে সব পক্ষের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়া কয়েক হাজার ইথিওপীয় সেনা সদস্যকে গত শুক্রবার টাইগ্রের আঞ্চলিক রাজধানী মেকেল্লের সড়ক দিয়ে হাঁটিয়ে কারাগারে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক প্রধান রোজমেরি ডিকারলো বলেন, ইরিত্রিয়ান সেনা ও আমহারার আঞ্চলিক বাহিনী সমর্থিত টাইগ্রেয়ান বাহিনী, টাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস (টিডিএফ) এবং ইথিওপীয় সেনাদের মধ্যে আরও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে, যা উদ্বেগজনক। আমরা টিডিএফকে অবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছি।’
শুক্রবারও টাইগ্রের আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলেতে কয়েক হাজার ইথিওপিয়ান সেনাকে কুচকাওয়াজ করতে দেখা যায়।
এ অবস্থায় শুক্রবার জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান রমেশ রাজাসিংহাম নিউইয়র্কে এক বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, সাম্পতিক সপ্তাহগুলোতে টাইগ্রের অবস্থা নাটকীয়ভাবে খারাপ হয়েছে। দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে সেখানে। প্রায় ৫২ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, যাদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু।
এদিকে, ওই অঞ্চলে সহায়তায় বাধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গত সপ্তাহে টাইগ্রের উত্তারঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকার দখল নিয়েছে সরকারি বাহিনী।
মূলত গত নভেম্বরে বিদ্রোহীরা রাজনৈতিক পুনর্গঠন প্রত্যাখান করলে এই অঞ্চলে সংঘর্ষ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা সেনাক্যাম্প দখল করে। এক মাস পর মেকেলে দখল নেয় সরকারি বাহিনী। তবে সম্প্রতি বিদ্রোহীরা মেকেল তাদের দখলে নেয় এবং শিরে শহরে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় সেখানকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
টাইগ্রে অঞ্চলের সাবেক শাসক দল টাইগ্রে পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) সোমবার জানায়, তারা আবার মেকেলে নিজেদের দখলে নিয়েছে। ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, তারা গত নভেম্বরের পর এই প্রথম টাইগ্রের আঞ্চলিক ইউনিফর্ম পরা সৈন্য দেখেছেন।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে টিপিএলএফ এর মুখপাত্র গেতাচু রেদা বলছেন, ‘টাইগ্রের রাজধানী মেকেলে এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’
এই ঘটনার পর অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে আতশবাজি ফুটিয়ে উল্লাস করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার ইথিওপিয়ার ফেডারেল সরকারের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা ২৮ জুলাই, ২০২১ তারিখ থেকে শুরু হবে। চলবে চাষের মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত।’
ইথিওপিয়ার চাষের মৌসুম মে মাসে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি এই দ্বন্দ্বের কার্যকরী সমাপ্তি আশা করছেন।
এক বিবৃতিতে অ্যান্তনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘বেসামরিক মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানুষের কাছে যাতে মানবিক সাহায্য পৌঁছায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’
২০১৮ সালে আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর দেশটির রাজনীতিতে পটপরিবর্তন শুরু হয়। প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটান তিনি। এ উদ্যোগের কারণে ক্ষমতাসীন হওয়ার এক বছরের মধ্যেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে যান আবি।
তবে তার রাজনৈতিক সংস্কারের বিরোধিতা করে বসে টাইগ্রের বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, এই সংস্কারের অজুহাতে আবি তাদের কোণঠাসা করে ফেলছেন। এই ঘটনা সরকারের সঙ্গে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের দীর্ঘদিনের বিরোধ উসকে দেয়। ফের শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত। টিপিএলএফের অভিযোগ, ইথিওপিয়ার সরকার টাইগ্রের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সরকারি সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে আবি সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ